আমেরিকার পূর্ব উপকূলে - TopicsExpress



          

আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ১৭ সতকের গোড়া থেকে ইউরোপীয় অভিবাসন শুরু হয়। ঠিক একই সময়ে পার্বত্য জনপদেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অভিবাসন শুরু হয়। তাহলে অভিবাসী মার্কিনীদের আদিবাসী না বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীদের কেন আদিবাসী বলা হচ্ছে? ব্যাখ্যা বোধ হয় এই যে, মার্কিন মুল্লকে রেড ইন্ডিয়ান নামে আদিবাসী আছে। ওদের ক্ষেপিয়ে তুললে অশনি সংকেত অনিবার্য। সুতরাং বিশ্বপুঁজিবাদপোষিত বুদ্ধিজীবী- গবেষক সে দিকে পা মাড়ান নি। তারা আগ্রহী তৃতীয় দুনিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর প্রতি। কারণ নানা ছলছুতোয় এমন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে পারলে পুঁজিবাদী অনুপ্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের পথ সুগম হয়। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের আনাগোনা শুরু হয় ষোল শতক থেকে। এ সময়ে আসামের মিজোরাম থেকে কুকি নামের উলঙ্গ জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। এদের অনেকে এদিক Ñ সেদিক বিচরণ করে ফিরে যেত; কিন্তু কেউ কেউ বসতি গড়ে, যাদের পরবর্তী প্রজন্ম আজও বিদ্যমান। একই সময়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী খাগড়াছড়ি এলাকায় বন কেটে বসত গড়ে, এবং জুম চাষ শুরু করে। ১৬৬০-এর দিকে, অর্থাৎ সতের শতকের মাঝামাঝি চাকমাদের একটি দল আদিবাস আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে রামু থানার অদূরে সাময়িক অবস্থান নেয়। তারা পরে আরো গহীন অরণ্য আলী কদমের দিকে এবং রাঙামাটির দিকে যায় স্থায়িভাবে বাস করার জন্য। মগ বা মারমা জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটে ১৭৮৪Ñর দিকে। প্রায় একই সময়ে বোমাঙদেরও আগমন ঘটে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের অধিবাস তাদের অভিবাসন হয়েছিল ষোল থেকে আঠারো শতকের মধ্যে। ১৯৯৭-র ২ ডিসেম্বর যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা যে দীর্ঘ এবং প্রলম্বিত আলোচনার ফসল তার কোন পর্যায়েই আদিবাসী দাবির সপক্ষে কোন প্রসঙ্গ ওঠেনি, বা চুক্তিতেও শব্দবন্ধটি স্থান পায় নি। কিন্তু ২০০৭-এর জাতিসংঘ ঘোষণার পর থেকে আদিবাসী সংক্রান্ত দাবিটি শ্রুত হচ্ছে। জাতিসংঘের ঘোষণাটিতে এমন জনগোষ্ঠীর জন্য আকর্ষণীয় বেশ কিছু প্রসঙ্গ আছে। যেমন তাদের আতœঅধিকার, অভ্যন্তরীন ও স্থানীয় বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন, ভূমির ওপর অধিকার, নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা, সামরিক কার্যক্রম প্রত্যাহার; এবং এমন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে জাতিসংঘের সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা। এছাড়াও প্রসঙ্গক্রমে আলোচ্য আই এল ও কনভেনশন। ’৫৭-র ১০৭ নং কনভেনশন বাংলাদেশ অনুমোদন করে ১৯৭২-এ। এ কনভেনশনের বিশেষ দিকগুলো ছিল: - জনগোষ্ঠীসমূহকে জাতীয় মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে। - তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্র সহায়ক হবে। - ভূমির ওপর তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। - নিরাপত্তা বা আর্থ-সামাজিক উদ্দেশে রাষ্ট্র এমন জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার জমি ব্যবহার করতে পারবে, তবে এলাকার জনগণের মতামত প্রয়োজন হবে, এবং যথাযথ পুনর্বাসন / ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। -এমন জনগোষ্ঠী দেশের প্রচলিত এবং অভিন্ন আইনে বিচারযোগ্য হবেন। বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানে এমন জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত দু’টি বিশেষ ধারা আছে। ২৩ ধারায় বলা হয়েছেঃ “রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।” বোধগম্য যে, রাষ্ট্রীয় সামগ্রিক স্বার্থে আই এল ও কনভেনশন এমন ধারায় পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলিত হয় নি। কিন্তু ২৮ (৪) নং ধারায় ব্যাপকভাবে বলা আছে , “নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।” সংবিধানের এমন দিকনির্দেশনা এবং সরকার / রাষ্ট্রের বাস্তব ভূমিকার মধ্যে কোন ফারাক আছে কী না বা এমন জনগোষ্ঠী কোনভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছে কী না, তা প্রসঙ্গান্তরে বিবেচ্য হতে পারে; এবং সে ক্ষেত্রে পার্বত্য জনপদবাসী সহমর্মিতার দাবিদার হতে পারেন। ১৯৮৯-এর আই এল ও কনভেনশন-১৬৯ বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিব্রতকর ছিল; ফলে তা অনুমোদিত হয় নি। এ কনভেনশনে জনগোষ্ঠীসমূহকে প্রকারান্তরে আদিবাসী (পুরনো / চিরস্থায়ী) বলা হয়েছিল। উপরন্তু, ছিল: - সব ক্ষেত্রেই তারা স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হবে, এবং রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে। - তাদের আত্মপরিচয় তাদের নিজস্ব-আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে বিবেচিত হবে। -এমন এলাকায় কোন খাস জমি থাকবে না। আর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অভিমত প্রাধান্য পাবে। উল্লেখ্য, এ কনভেনশন অনুমোদন করলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতো। বলা যেতে পারে, জাতিসংঘের ২০০৭-এর ঘোষণা এ কনভেনশনের সম্প্রসারণ মাত্র। চূড়ান্ত মন্তব্য: পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অধিবাস তারা ইতিহাসের নিরিখে মূলত অভিবাসী। কিন্তু এখন অভিবাসী নয়, নাগরিক-বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের মতোই। কিন্তু তারা আদিবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোনটিই নয়, তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, এবং তা আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে। সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আর বড় জাতিসত্তা বাঙালি নিয়ে বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলাদেশ মানচিত্রের ভেতর কোন গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি যুক্তিযুক্ত হলেও তার আত্মঅধিকার প্রয়োগের প্ররোচনা অনাকাংক্ষিত ও বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রসূত। একই সমান্তরালে বিবেচ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের উন্নয়ন ঘাটতি ও অধিকার বঞ্চনার বিষয়সমূহ। সুতরাং মনে হয়, সংবিধান ও শান্তিচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলে বাইরের কোন দুরভিসন্ধি হালে পানি পাবে না। উপরন্তু, প্রয়োজন জনগোষ্ঠীসমূহের বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গী ও ভূমিকা। অবশ্য সর্বাগ্রে অনুঘটকের ভূমিকা সরকারের-ই; এবং যাতে কোন ভ্রান্তি ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কালক্ষেপন দেশ ও সরকারের জন্য আত্মবিনাশী হবে। [1] বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য Syed Anwar Husain, Bangladesh, National Scenario, Foreign Policy and SAARC (Dhaka: Agamee Prokashoni, 2003. [2] Max Weber, “Economy and Society” in Guenther Roth and Claus Wittich (eds.) Trans. Ephraim Fischof vol. 2. (Berkeley, University of California Press, 1998); Anthony D. Smith, The Ethnic Origins of Nations (Oxford: Blackwell, 1986). [3] Louis Morgan, An Introduction to Anthropology, 1972. [4] দ্রষ্টব্য Syed Anwar Husain, War and Peace in the Chittagong Hill Tracts (Dhaka: Agamee Prokashoni, 1999) P. 48. অবশ্য সুজে সাঁওতাল এ তালিকায় নেই, এদের সন্ধান পেয়েছি ২০০৭-এ ঐ এলাকায় তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে। লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Posted on: Thu, 07 Aug 2014 02:52:10 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015