আমার পরিচয়ঃ জাতি ও - TopicsExpress



          

আমার পরিচয়ঃ জাতি ও জাতীয়তাবাদ নূর মোহাম্মদ কাজী আমার পরিচয়, জাতি ও জাতীয়তাবাদ কি? আমরা কিভাবে বাঙালি হলাম, বাঙালি জাতীয়তাবাদী হলাম? এ প্রশ্নগুলুর উত্তর আমি আমার বাল্য, কৈশর, তারুন্য, যৌবনকাল, এমন কি বর্তমানের যৌবন-ভাটি কালে এসেও খুঁজছি। পথের দিশা হাতড়ানো এ প্রশ্নগুলু নিয়ে এবারের পিতৃ-দিবসে আমরা সবার সাথে মতামত শেয়ার করতে চাই। আমার আত্মপরিচয় আমার আমি হয়ে উঠা, বাঙালি হওয়া ও জাতীয়তাবাদী হওয়ার মধ্যে আমার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। প্রকৃতির লীলাবৈচিত্রে ভরা বংগীয় বদ্বীপ। এ বংগীয় বদ্বীপে আমি জন্মেছি। আমার বাবা-মার ভালোবাসার ফসল আমি। আমার বাবা-মা ছিলেন অস্ট্রো-এশিয়াটিক রক্ত-ধারার এথনিক বাঙালি। এ রক্ত-সম্পর্ক প্রকৃতি প্রদত্ত। বাবা-মার সম্পর্ক সূত্রে প্রকৃতি আমাকে বাঙালি করেছে। প্রকৃতি থেকে অর্জিত সম্পর্কবোধ আমাকে জাতীয়তাবাদী করেছে। এ অর্থে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী। বংগীয় বদ্বীপের প্রাকৃতিক লীলাভূমিতে আমাদের পুর্বপুরুষগণ সহস্র বছরের জাতীয়তাবাদী সম্পর্কের সাধনায় এক আবাসভূমি গড়ে তুলেছিলেন। সাম্প্রতিক নৃতাত্ত্বিক ও জেনেটিক গবেষনা জাতীয়তার এ দিকটি প্রমানসিদ্ধ করে তুলেছে। প্রকৃতির স্বেচ্ছাচারীতা ও বহিরাগতদের আধিপত্য আমাদের পুর্বপুরুষদের একদিকে সংগ্রামী এবং অপরদিকে জাতীয়তাবাদী করে তুলেছে। এ সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে আমরা এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছি। এ যুদ্ধের কিছু গৌরবজনক স্মৃতি-কথা আমার মনে সঞ্চিত রয়েছে। আমার আত্ম-পরিচিতির সাথে আমার জাতীয়তাবোধের সম্পর্ক রয়েছে। এর সাথে রয়েছে আমার পরিবারের এথনিক রুটের সম্পর্ক। আমার পিতা মৌলভী মোহাম্মদ আমির উদ্দিন কাজীর স্মৃতিই আমাকে সামনে এগিয়ে যাবার শক্তি জোগাচ্ছে। তিনিই আমার জীবনের প্রথম বীর ও আদর্শ পুরুষ। তার প্রদর্শিত আদর্শ আমার জীবনের বড় পাথেয়। আমার দাদা ছিলেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন কাজী (কানু গাজী) আর আমার দাদার ছোট ভাই ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন কাজী। তাঁরা দু’ভাই বৃটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন। আমার বড় দাদা মোহাম্মদ শরিফুদ্দিন কাজী তাঁর পীর ভাই মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন শক্কর গঞ্জের সাথে চাঁদপুর এলাকায় ইসলাম প্রচারে আগমন করেছিলেন। মোহাম্মদ শরিফুদ্দিন কাজীর বাবা মোহাম্মদ মুসলিমউদ্দিন কাজী ত্রিপুরা রাজ্যের কুমিল্লা শহরবাসী ছিলেন। ন্নন্নন বাব আলীবর্দ্দী খাঁর আমলে মোহাম্মদ মুসলিমউদ্দিন কাজীর পিতা মোহাম্মদ জামালউদ্দিন কুমিল্লায় কাজী হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। আমার বড় দাদা তাঁর পীর ভাই মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন শক্কর গঞ্জের সাথে ইস লাম প্রচারের লক্ষ্যে ফরিদগঞ্জে এসেছিলেন। এ এলাকা তখন মেঘনা শিকস্তি এলাকা ছিল। নৌকা ছাড়া চলাচল অসম্ভব ছিল। তিনি তার পীরের সাথে ধর্ম প্রচারে এলাকার বিভিন্ন স্থানে নৌকায় ব্যাপকভাবে সফর করেছিলেন। এ এলাকায় বেশ কয়েক বছর ধরে তাদের বজরা নৌকায় বসবাস করতে হয়েছিল। এ সময় তাঁদের নৌকায় কয়েকবার ডাকাত আক্রমণ করেছিল। এ কারনে ফরিদগঞ্জ-হাজিগঞ্জ জুড়ে মেঘনার যে শাখা নদীটি প্রবাহিত হয়েছে তার নাম হয়ে যায় ডাকাতিয়া নদী। আমার বড় দাদাকে এলাকায় রেখে পীর ফরিদউদ্দিন শক্করগঞ্জ ফরিদপুর এলাকায় ইসলাম প্রচারে চলে যান। পীর মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন শক্করগঞ্জের নামানুসারে এ এলাকার নাম হয় ফরিদগঞ্জ। ফরিদপুর নামটিও এ পীরের নামের সাথে জড়িত। পীর মোহাম্মদ ফরিদউদ্দিন শক্কর গঞ্জ এতদঞ্চলের অসংখ্য মানুষকে ইসলাম ধর্মে আনয়ন করেন। দ্বীনের দাওয়াত শেষে তিনি তার জন্মভূমি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে চলে যান। আমার বড় দাদা ফরিদগঞ্জ বাজার সংলগ্ন সাফুয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। আমার দাদা সাইফুদ্দিন কাজীকে গ্রামের মানুষ শ্রদ্ধা করে তাকে ডাকত “সাইফু বাবা” বলে। পরে তার নামানুসারে গ্রামের নাম হয় সাফুয়া। আমার দাদা সাইফুদ্দিন কাজী (কানু গাজী) তরুন বয়সে বৃটিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ গমণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার পর তার বীরত্বপুর্ন লড়ায়ের কথা সমগ্র চাদপুর এলাকায় ছড়িয়ে যায়। তার সহযোদ্ধারা তাঁকে বৃটিশ বিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহের মহান বীর “কানু”র সমতুল্য বীর মনে করে “কানু গাজী” নাম দিয়ে ছিলেন। চাঁদপুরের বিস্তৃর্ণ এলাকায় আমার দাদা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন কাজী “কানু গাজী” হিসেবে বহুলভাবে পরিচিঁত ছিলেন। বৃটিশ বিরোধী প্রতিরোডধ যুদ্ধে অংশ গ্রহনের কারনে আমার দাদা স্থানীয় জমিদারের কোপানলে পড়ে ছিলেন এবং আজীবন অত্যাচারিত হয়েছেন। স্থানীয় জমিদার তার উপর ক্রমাগত অত্যাচার চালিয়ে ছিল। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। স্থানীয় রুপসারা জমিদার তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছিল। গুলি চালিয়েছিল হত্যা করার জন্য। কিন্তু তিনি আপোষ করেন নাই। লড়াই থেকে পিছপা হন নাই। মামলার হাজিরা দিতে হতো কুমিল্লায় গিয়ে। ফরিদগঞ্জ থেকে ৪০ মাইল পথ পায়ে হেটে সে সময় কুমিল্লা যেতে হত। শেষ বার হাজিরা দিতে গিয়ে আমার দাদা কুমিল্লাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কুমিল্লার বিখ্যাত সুজা বাদশা মসজিদের ইমাম দাদার সহযোদ্ধা ও বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর দাদা তার এ বন্ধুর মসজিদ প্রাংগনের বাসায় ইন্তেকাল করেন। লাশ নিয়ে চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করে ফরিদগঞ্জে আনা সে সময় অসম্ভব ছিল। ইমাম সাহেবের পরামর্শ ক্রমে আত্মীয়-স্বজনরা সুজা বাদশার মসজিদ সংলগ্ন সমাধিতে তাকে দাফন করার সিদ্ধান্ত নেন । উল্লেখ্য, বৃটিশ বিরোধী অনেক বীরকে এ সমাধিতে দাফন করা হয়েছিল। মনে পড়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমার বাবা আমাকে এ সমাধিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা সেখানে কোরান তেলাওয়াত, দোয়াখানি তাঁর কবর জিয়ারত করি। আমার দাদা তাঁর তিন ছেলে সন্তানকে শিক্ষিত করেছেন। তার মেঝ ছেলে মোহাম্মদ আমির উদ্দিন কাজীকে তিনি ইসলামী শিক্ষা গ্রহনের জন্য দেওববন্দে পাঠিয়ে ছিলেন। দেওবন্দের শিক্ষা সমাপ্ত করে বাবা নোয়াখালির শান্তা-সীতার পীরের প্রধান খলীফা হন। তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার বাবা পীরের সাথে দেশেরর বিভিন্ন এলাকায় মুরিদদের দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। নিজ গ্রামে তিনি কমই আসতে পারতেন। গ্রামের মানুষরা বেজার হয়ে আমার বাবার নামে গান বেঁধেছিলেন- “যার নাইগো মাতা-পিতা-তিনি থাকেন শান্তা-সীতা”। ঢাকার টংগী ও জ্য়দেবপুর এলাকায় আমার বাবার অনেক মুরিদ ছিলেন। মসজিদের ইমামতি এবং মুরিদদের দ্বীনি শিক্ষাদান করেই তাঁর জীবন কেটেছে। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ফরিদগঞ্জ এলাকায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবাহের পর তিনি ঘরমুখী হয়েছিলেন। আমার মা মিসেস আশূরা খাতুন পরহেজগার মহিলা ছিলেন। পরিবারে ছয় ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট ছিলাম। ধর্মীয় কাজ এবং অর্থ উপার্জনের কাজ এক হওয়ায় বছরের বেশীর ভাগ সময়ই বাবাকে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। মা ফরিদগঞ্জ বাজারের মুদি দোকান থেকে কেনা আদর্শলিপি দিয়ে প্রথম আমাকে লেখা পড়ার হাতে খড়ি দেন। বড় হওয়ার পর বাবা আমাদেরকে সময় দিয়েছেন। ওয়াজ-নছিহতের জন্য জ্ঞান সাধনার দরকার। এ জন্য বাবাকে সদা পবিত্র কোরান ও হাদিস পাঠে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। তাঁর পাশে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি। তিনি কখনও রাগ করতেন না। আমার প্রতি বা আমার বড় ভাই ও বড় বোনের প্রতি কখন ও রুক্ষ আচরন করেননি। আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক সূরা-কেরাত ও ফারসী বয়াত শিখেছি। যা আজ ও মুখস্ত আছে। যে ফারসী বয়াত আমার সব সময় মনে পড়ে, তা হলঃ আঁকে বাত ঘরকে যাদা ঘরকে ছাওয়াদ, ঘরছে বায়াদ আমি বুজর্গে ছাওয়াদ। এর অর্থ হলঃ “বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়”। তিনি বয়াতটি বিশ্লেষণ করে বলে ছিলেন, “ভাল মানুষের ঘরে ভাল সন্তান আর খারাপ মানুষের ঘরে খারাপ সন্তান জন্মে। জ্ঞানী মানুষের সন্তান জ্ঞানী হবেই হবে”। আমি বাবাকে অনেক প্রশ্ন করতাম। তিনি ধৈর্য্য ধরে আমার প্রশ্নগুলু শুনতেন এবং একটি একটি করে উত্তর দিতেন।মনে পড়ে একদিন বাবাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “আচ্ছা বা’জান, আপনি ওয়াজে মানুষকে কি নছিহত করেন”? বাবা বললেন, “কোরান ও সুন্নাহ মোতাবেক চলার জন্য আমরা মানুষের প্রতি আহবান জানাই।এক মানুষের প্রতি অপর মানুষের ভালোবাসার কথা বলি। আর জালেমের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মজলুম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহবান জানাই। ইসলাম জালেমের অত্যাচার থেকে মজলুমকে রক্ষা করার ধর্ম।” তিনি প্রায়ই “জালেম” ও “মজলুম” শব্দ দু’টি ব্যবহার করতেন। মজলুম মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তাঁর অসংখ গরীব-দু;খী মুরীদ ছিল। মুরিদরা তাঁকে “বাবা” বলে সম্বোধন করত। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। তার জীবনের বড় অংশ কেটেছে গরিব মানুষদের সেবা করে। পাকিস্তান অর্জনের আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। আজ থেকে ৪৫ বছর পুর্বে ১৯৬৫ সালে বাবা যখন ইন্তেকাল করেন, তখন বুকের উপর একটি ছোট পবিত্র কোরান শরীফ দেখা গেল। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব এসে তাঁর বুক থেকে উক্ত কোরান শরীফ সরিয়েছিলেন। জ্ঞান সাধনার প্রতি বাবার এ আগ্রহ আমি কখন ও ভুলতে পারি নাই। যদিও বাবার মৃত্যুর পর আমার বড় ভাই মমতাজ উদ্দিন কাজী সংসারের দায়িত্ব গ্রহন করলেন, তবুও বাবার মৃত্যুকে আমি নিজের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি বলে ধরে নিয়েছিলাম। বাবার কাছে আমার অনেক কিছু শেখার ছিল, শেখা হল না। এ জন্য মনে এক ধরনের দুঃখ বোধ দানা বেধেঁ রইল। জ্ঞান সাধনার প্রতি আগ্রহ আমার সারা জীবনের। এটাই মনে হয় আমার প্রতি বাবার অনির্দেশিত নির্দেশ ছিল। আমার জাতীয় পরিচয় আমরা কিভাবে জাতীয়তার স্তরে উত্তীর্ন হলাম? তা কিছুটা বলা দরকার। আজ থেকে অর্ধ-শতাব্দির আগের কথা। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ-ঊপনিবেশবাদী শক্তি বহু-জাতিক ভারত বর্ষকে ধর্মভিত্তিক দু’টি রাস্ট্রঃ পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টি করে কেবল বিদায় নিয়েছে। ১৯৫২ সালের এ সময়ে এক সুর্যালোকিত সকালে আমার মা আমাকে সাথে নিয়ে কুমিল্লা জেলার ফরিদগঞ্জ থেকে ঢাকায় আগমন করেন। আমার বাবা তখন পুরানা ঢাকার ছুড়িটোলা মসজিদের ইমাম। মসজিদের কাছেই বাসা। বাসার ডান দিকে ঢাকার আদি বাসিন্দাদের বাস। তারা ভাংগা উদ্দু’তে কথা বলে । আর বাম দিকে বিহারীদের কলোনী।এরা হিন্দু-মুসলিম দাংগার কারনে ভারতের বিহার রাজ্য থেকে রেফিউজী হিসেবে ঢাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। এদের ভাষাও উর্দ্দু’। বালক আমি।বন্ধু চাই। ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মাঝে বন্ধু পাব এ আশা করে বাসার ডান দিকে যারা খেলছে তাদের কাছে গেলাম। আমাকে দেখে বড় মত ছেলেটি বলল, “তুমি হালায় বাঙাল, গাঁও থাইকা উইড়া আইছ পুইড়া খাইবার লাইগা, ইখান থেকে যাও।” আমি কান্না ভরা কণ্ঠে সেদিন মাকে প্রশ্ন করেছিলাম, মা ওরা আমাকে “বাঙাল” বলে গালি দিল কেন? আমি খেলব কাদের সাথে? আমি খেলার সাথী পাব কোথায? মা বল্লেন পাবে, সবুর কর। কতদিন আর একা থাকা যায়। এবার গেলাম বিহারী কলোনীর দিকে। তারা আমাকে খেলায় নিল। প্রথম দিকে ওদের ভাষা বুঝতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। পরে ঠিক হযে যায়। একদিন সাথে খেলায না পেরে তাদের একজন আমাকে বলল, “তোম লোগ বাঙালী হায়, মাছলি খাতা, তাকাত নাহি হায়। হাম লোগ গোশ খাতা, তাকাত জাদা হায়”। পরদিন থেকে আমি আর ওদের ওখানে খেলতে গেলাম না। মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকি। আমার মা খুব মিশুক প্রকৃতির মাহিলা ছিলেন। আমাদের বাসা থেকে বের হলে একটি গল্লি, তার পরই আমার মার বান্ধবীর বাসা। আমার মন খারাপ দেখে মা বল্লেন, চল আমার বান্ধবী জমকার মার বাসায় যাই। জমকার মা জমজ দু’ছেলের মা।এর জন্য ওর নাম জমকার মা। জমজ দু’ভাই আমার বয়সী। আমি ওদের পেয়ে খূব খূশী। এর পর থেকে আমি ওদের সাথেই খেলাধুলা করি। একদিন বিকালের কথা। গলির মোড়ে আমরা তিন বন্ধু খেলছি। দেখলাম আমাদের গলির ভিতর মিছিল ডূকছে। তারা শ্লোগাণ দিচ্ছেঃ “আমার ভাষা, তোমার ভাষা-বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষা; রাস্ত্র ভাষা বাংলা চাই-নুরুল আমিনের মূন্ডূ চাই।পদ্মা, মেঘনা, যমুনা-তোমার আমার ঠিকানা; আমার দেশ, তোমার দেশ-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ; জ়াগো, জ়াগো- বাঙালী জ়াগো; জ়য় বাংলা। মিছিলের শ্লোগাণগুলি যেন আমার মনের কথা। দু’জমজ বন্ধুকে বললাম, চল মিছিলে যাই।আমরা তিন জন মিছিলে সামিল হয়ে গেলাম। অনেক বড় মিছিল ছিল। সেদিন অনেক শ্লোগাণ দিয়েছিলাম। বেশী শ্লোগাণ দিয়েছিঃ জ়াগো, জ়াগো- বাঙালী জ়াগো; এ শ্লোগাণ আমার প্রিয় ছিল। আমাদের মত অনেক ছেলে-মেয়ে এ মিছিলে ছিল। মিছিলের বড় ভাইরা বললেন, কেহ মিছিল থেকে বাহির হবে না। আমরা তোমাদের বাসার কাছে ফিরে গেলে তোমরা বাসায় চলে যাবে। তিন বন্ধু সেদিন রাত ১০টায় বাসায় ফিরি। দেখি, আমার মা আর জমকার মা কান্নাকাটি করছে।আমাদের দেখে তাদের কি যে আনন্দ! আমাদের বললেন, আর কখনো এভাবে যাবি না। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না ভরা কন্ঠে বললাম, মা আজ থেকে আমার কোন দুঃখ নেই। আমি আজ একা নই। আজ সারা শহরের সবাই বলছে, তারা বাঙালী।ওরা আমাকে “বাঙাল”, “বাঙালী” বলে গালী দিয়েছে বলে আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। আজ আমি সারা শহর ব্যাপি শ্লোগাণ দিয়ে জানিয়ে এসেছি, আমার পরিচয়ঃ আমি বাঙালী; আমার ভাষা বাংলা; আমার দেশ বাংলাদেশ। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মা খুশীতে হাসছেন। শৈশবের কয়েক বছর ঢাকায় থাকার পর আমরা গ্রামের বাড়ীতে ফিরে যাই।এখানে আমি প্রাইমারী ও হাই স্কূল পাশ করি। এ গোটা সময় ধরে আমি ঢাকার স্মৃতি ভুলতে পারি নাই।আমি বাংগালী এ বিষয়টি আমার মনে সদা জাগ্রত ছিল।অস্টম শ্রেণীতে পড়াকালে বাবা ইন্তেকাল করেন। বড় ভাই ঢাকায় চাকূরী করেন। তার রোজির উপর গোটা পরিবার নির্ভরশীল। এস,এস,সি ফাস্ট ডিভিশন পাওয়ায় আমার ভাই বল্লেন, “রেজাল্ট যখন ভাল হয়েছে। তা’ হলে ঢাকায় চল, ওখানেই যে কোন একটি ভাল কলেজে পড়া-শুনা করবে”।উল্লেখ্য যে, সে সময় শুধু চাঁদপুরেই একটি কলেজ ছিল, ফরিদগঞ্জে কোন কলেজ ছিল না। আমি তো মহা খুশী। আমার স্বপ্নের শহর ঢাকায় আবার আমি যাব। আবার শ্লোগান দিতে পারব “জাগো, জাগো- বাঙালী জ়াগো”।কি মজা হবে। ঢাকার পথে এটা আমার দ্বিতীয় যাত্রা।১৯৬৭ সাল।এবার আর মা সাথে নেই। মা দোয়া করে বল্লেন, এবার তোমাকে আল্লার হাতে সফে দিলাম। এবার তুমি আর ঢাকায় হারাবে না। এখন বড় হয়েছ। বড় ভাই তো ঢাকায় থাকবেই।যা সহযোগিতার দরকার সে তোমাকে করবে। তখন ফরিদগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে প্রথমে পায়ে হেটে বা নৌকায় করে চাঁদপুর আসতে হতো। পরে চাঁদপুর থেকে লঞ্চে করে ঢাকার সদরঘাঠে আসা সহজ ছিল। রাতের লঞ্চে রওয়ানা দিয়ে সকালে এসে সদর ঘাট নামতে হতো। যথারীতি সকালের আরেক সুর্যালোকে সদরঘাটে এসে নামলাম। হাতে একটা ভারী সুইট-কেইস। এতে রয়েছে দৈনন্দিন প্রয়োজ়নীয় জিনিস। যেতে হবে নিউমার্কেট। সেখানে আমার ভাই থাকে। বাস ধরতে হবে। বাস রুট হল ইসলামপুর রোড ধরে চকবাজার,চকবাজার থেকে লালাবাগ রোড ধরে লালবাগ কিল্লার মোড়, তারপর আজিম্ পুর হয়ে নিঊমার্কেট। তখনকার বাসগুলু ছিল খুব ছোট। নাম ছিল “মুড়ির টিন”।বাস ছেড়ে দেয় দেয় অবস্থা।বাসের বিহারী হেল্পার হাক-ডাক দিচ্ছে, “বাস ছোড় দিয়া, বাস ছোড় দিয়া; জলদি আইয়ে, জলদি আইয়ে”!বাস আগাচ্ছিল, আর পিছাচ্ছিল। আমি দৌঁড়ে গিয়ে বাসে উঠতে গেলাম।হেল্পার বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে হাক দিচ্ছে। সে আমাকে জায়গা দিচ্ছে না। জ়োর করে যেই উঠতে গেছি, অম্নি বেচারা হেল্পার ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল।হেল্পার আমার বয়সি ছিল, কিন্তু আমি গ্রামের তরুন আমার শক্তি আলাদা। সে কান্না ভরা কন্ঠে চিত্কার দিতে লাগল আর বলতে ছিল, “মোজ়েকো গিরা দিয়া,মোজ়েকো গিরা দিয়া”। ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, “কেয়া হুয়ারে কেয়া হুয়া”। হেল্পার বলল, “বাঙ্গাল মোজ়েকো গিরা দিয়া”।আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম।বাসের পিছনের দিকে গিয়ে আমি হেন্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছি গন্তভ্যস্থানে পৌছার আসায়। আর ভাবছি, বহু দিন পর আবার গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এলাম। এসেই বিহারীদের সাথে আবার সংঘাতে জড়িয়ে গেলাম।ওরা ভাল লোক নয় ।আমাদের দেখতে পারে না।এ সব চিন্তা করছি আর ততক্ষনে বাস ছেড়ে দিয়েছে।হেল্পার এখন টিকেট কাটা শুরু করেছে।সে আমার কাছে এসে আমাকে তার কনুই দিয়ে গুতা মেরে বলল, “টিকিটকা পয়সা দাও। তু বাঙাল হায়, তেরা বদনছে মাছলিকা বদবু নিকালতা হায়”।আমি তাকে ভাড়ার পয়সা দিয়ে টিকিটতা হাতে নিয়ে বললাম, “তু বিহারী হায়, তেরা বদনছে চিকাকা বদবু নিকালতা হায়”। উল্লেখ্য যে, ইতিপুর্বে আমি যখন ঢাকায় ছিলাম বিহারী ছেলে- মেয়েদের সাথে আমাকে ঝগড়া করতে হয়েছ।আমি জানতাম বিহারে নদী কম। পানির অভাব। এ জন্য বিহারীরা গোসল করে না। ওদের শরীর থেকে ইদুর পঁচা দুর্গন্দ বের হত। আমার প্রতিবাদের ভাষা শুনে ড্রাইভার বুঝে সেরেছে যে,এক নাছোড় ছেলে বাসে উঠেছে। সে হেল্পারকে হাক দিয়ে বলল, “রাহিম চুপ করকে টিকিট কাটো”। এ ঘঠনা পরবর্তিতে আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। বাসের বিহারী হেল্পার আমাকে বাঙাল বলে গাল দিল কেন? আমার গা থেকে মাছের গন্ধ বেরোয় এ কথা বলল কেন? তবে কি এ শহর আমার নয়? এ প্রশ্ন দ্বিতীয়বার আমার মনে উদিত হল। আমার জাতীয়তাবাদ আমি ঢাকার সে সময়কার বড় কলেজ় জগন্নাতে ভর্তি হলাম। কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল জনাব বোরহান উদ্দীন স্যার আমাকে কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর অজিত গুহের সাথে পরিচয় করে দিলেন।ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা অজিত গুহ আমাকে বললেন, “আমি এবার কলেজে এডভান্স বেংগলী নামে একটি নতুন বিভাগ খুলেছি। আমি আশা করছি তুমি বিষয়টি নেবে এবং তোমার মুল কোর্সসমুহের অন্তর্গত করবে। ভাল ছাত্ররা বাংলা পড়ে না বলেই বাংলা ভাষার অগ্রগতি হচ্ছে না। বাঙালি জ়াতি সম্পর্কে মানুষ জ়ানে না”। আমি আগ্রহ সহকারে স্যারের কথা শুনলাম।আমার মনে হল এ কথাগুলু শুনার জন্য আমি অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। বিহারী বালকের কথা আবার আমার মনে পড়ল, “তু বাঙাল হায়, মাছলি খাতা”। আমি মাছ খাই। আমি বাঙাল । এরা আমাদেরকে এ সব খোটা দেয় কেন? মাছ ভাত কি কোন দোষনীয় খাদ্য? আমার মনে এ সব প্রশ্ন সব সময়ই জাগত। এডভান্স বাংলা পড়তে গিয়ে আমি শিখড় সন্ধানী হলাম। বাংলা ভাষার ইতিহাস আমার সামনে এলো। বাংগালি কারা? আর্য আগমনের আগে হাজার হাজার বছর ধরে যারা বঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তারাই তো বাঙালি। এ আদি বাঙালিদের বর্ণবাদী হিন্দুরা “অনার্য” ও “নমঃশূদ্র” নাম দিয়েছিল। আর বাংলা অঞ্চলকে নাম দিয়েছিলঃ “দুর্ধর্ষ অনার্য আবাস”। এ জনগোষ্ঠী প্রকৃতি পুঁজারী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। এদেরকে বর্ণভুক্তির কোন পথ আর্যদের কিতাবে ছিলনা। আজো নাই। কারন বর্নবাদ রক্ত-সম্পর্ক-জাত ধারাবাহিকতার (Religion of blood line) ধর্ম। এর থেকে বর্ণবাদ বের হয়ে আসতে পারবে না। আবার অন্য কোন মানব গোষ্ঠী এ বর্নবাদী ধর্ম গ্রহনও করতে পারবে না। এ কারনে আদি বাঙালির বিশাল জনগোষ্ঠিকে বহিরাগত বর্ণবাদী আর্যরা “চন্ডাল” নাম দিয়ে যখন নিপীড়নের পথ বেছে নিল, তখন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী বাঙালি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। ইসলামের সাম্য-চেতনা তাদেরকে এ ধর্মমত গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ করেছিল। ১০ম শতাব্দি থেকে এ ধর্মান্তর ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত চলেছিল। যেহেতু বাংলার এথনিক বাঙালিরা হিন্দু ধর্মের সাথে একাত্ম না হয়ে ইসলামের আদর্শ ও জীবন ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হলেন, সেহেতু তাদের জাতীয়তা ইসলামি আধ্যাত্মিকতার সাথে যুক্ত হয়ে গেল। ইসলাম ধর্মের জীবন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত হবার পর আদি বাংগালি এক হাজার বছর ধরে নিজস্ব ধর্মভিত্তিক কৃষ্টি-কালচার গড়ে তুলেছেন। আরো পেলাম হাজার বছর পুর্বে লেখা (শংকরাচার্যের সময় বৌদ্ধ নিধনের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাংলা থেকে পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধ কবিদের লেখা, নেপালের রাজ দরবারে পাওয়া) বৌদ্ধ-দোহা,ভুশূকী কবির বাণী-“আজি ভুশূকী বাঙালী ভঁইলী”।দেখতে পেলাম আমার বাঙ্গালীত্ত্বের চেতনা হাজার হাজার বছর ধরে বিন্যস্ত হচ্ছে। গংগা নদীর এ অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী এ জনগোষ্ঠী প্রাথমিক পর্যায়ে মাছ শিকারী (শিকার যুগ) ছিল।এ জন্য শব্দ প্রয়োগে আমরা বলি “মাছে-ভাতে বাঙালি”- “ভাতে-মাছে বাঙালি” বলি না। পরবর্তিতে কৃষি জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হলে ও আমাদের জীবন ধারনের মৌলিক ক্যালোরির যোগান আসত মাছ থেকে। বাংলা ছিল নানারুপ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এ সম্পদের লোভে সে সময় বাহির থেকে বহু জাতির মানুষ এ দেশে এসেছে এবং এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে্ন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেনঃ হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন শক, হুণ দল, মুঘল, পাঠান এক দেহে হল লীন এরা বাহির থেকে শূন্য হাতে নানা ধর্ম, নানা মত আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে। এসব মতবাদের সুবাদে তারা বাঙালি আধিবাসীদে উপর কর্তৃত্বশীল হয়েছিলো। তবে এদেশে এসে তারা যখনই আমদের পুর্বপুরুষদের নিজস্ব অর্জন সাম্য, স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রকে আত্বস্থ না করে, এসব মুল্যবোধের বিরুদ্ধে গিয়েছে তখনই প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। কারা এ প্রতিরোধ গড়েছে? পিতৃতান্ত্রিকতার মাধ্যমে গড়ে উঠা জাতীয়তাবাদীরাই এ প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছেন। এ প্রবন্ধ শুরু করে ছিলাম আমার পরিচয়, জাতি ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলার অঙ্গীকার নিয়ে। কিভাবে আমি বাঙালি হলাম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী হলাম তা আমরা উল্লেখ করেছি। এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের মেজোরিটি মানুষের ধর্ম বিশ্বাস হলো ইসলাম। আর ইসলাম হলো পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম। আমাদের সমাজ গড়ে উঠেছে এ পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই। উল্লেখ্য, প্রজন্ম রক্ষার তাগিদে মানুষ শুধু পরিবারই গঠন করেনি, তাকে ধর্ম, সমাজ, এমন কি রাষ্ট্র পর্যন্ত গঠন করতে হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল। ভারতীয় সমাজ মুলতঃ মাতৃতান্ত্রিক। এশিয়ার বহুদেশ মাতৃতান্ত্রিকতা ছিল। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিবারের কেন্দ্রে থাকেন মা। চীনা দার্শনিক কনফুশিয়াসের ভুবন-কেন্দ্র ছিল পরিবার। তিনিই হলেন পৃথিবীর পুর্ব-গোলার্ধের পারিবারিক মূল্যবোধের জন্মদাতা। ব্যক্তি এখানে পারিবারিক দলীয়-স্বত্ত্বায় লীন। এখানে পারিবারিক স্বত্ত্বাই স্বীকৃত। ব্যক্তি-স্বত্বার আলাদা কোন স্বীকৃতি নাই। পৃথিবীর পুর্ব-গোলার্ধে হাজার হাজার বছর ধরে পরিবার কেন্দ্রিক যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠেছিল, ধর্মসমুহ তার বাহিরে যেতে পারেনি। পরিবারকে কেন্দ্র করে এ মাতৃশাসিত সমাজ এশিয়ার দেশে দেশে বিরাজমান ছিল। তবে পশ্চিমা সমাজ মাতৃতান্তিক সমাজ জীবন থেকে বের হয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলেছিল। এখানে ধর্মসমুহ পিতৃতান্ত্রিকতাকেকে প্রাধান্যে নিয়ে এসেছিল। পিতৃতান্ত্রিকতা পরিবারের বাহিরে এসে কৌম, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য গড়ে তোলার দিগন্ত উন্মোচন করলো-যা হাজার হাজার বছরেও মাতৃতান্ত্রিকতা করতে পারেনি। মা্তৃতান্ত্রিক সমাজ পরিবারের গন্ডি থেকে বিশ্ব-দৃষ্টি বিকশিত করতে পারেনি। পিতৃতান্ত্রিকতা পরিবারের গন্ডি ভেংগে কৌম, জাতি, রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য গড়ে তুলল। ইসলাম, খৃষ্টিয়ানিটি, জুদাইজম পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আদর্শ ধর্ম। কৌম, জাতি,রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পিছনে পুরুষের বুদ্ধি, জ্ঞান ও ক্ষমতা কাজ করেছে। বিজ্ঞান বিকশিত হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষ কতৃর্ত্ত্বের সমাজ। এ সমাজে পুরুষ পরিবার, কৌম, জাতি, রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের কর্তা। পুরুষ ধর্মাবতার। ইসলামের পীর (পিতা শব্দ থেকে উত্পত্তি), খৃষ্টিয়ান সমাজে ফাদার (পিতর থেকে ফাদার শব্দের উত্পত্তি), জুদাইজমে রাব্বী(রব শব্দ থেকে রাব্বী শব্দের উত্পত্তি), বুদ্ধইজমে ভিক্ষুর স্থান সর্বোচ্চ। এরা সবাই পিতৃতান্ত্রিকতার প্রতীক। ইসলাম, খৃষ্টিয়ানিটি ও জুদাইজমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক আদি পিতা আদম তৈরীর বর্ননা রয়েছে। মা হাওয়াকে আদমের শরীরের অংশ হিসেবে বর্ননা করা হয়েছে। নারী পুরুষের সাপ্লিমেন্টারী হিসেবে বর্ননা রয়েছে। নারীর স্বকীয় পরিচয় ধর্ম মতে স্বীকার্য নয়। তাই সকল ধর্মই পুরুষ ব্যক্তিত্ত্ব গড়ার দিকে মনোযোগী হয়েছে। উত্তম পুরুষ তৈরীর কাজ ধর্ম গ্রহন করায় ধর্মের দৃষ্টিতে পীর, ফাদার, রাব্বী, ব্রাক্ষ্মন ও ভিক্ষুই হলেন উত্তম পুরুষ। কয়েক হাজার বছর ধরে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলু ধর্মমতের উত্তম পুরুষ বানাচ্ছে। এ উত্তম পুরুষগন সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শ মানুষ। রাব্বুল আলামিনের প্রতিনিধি। ধর্মীয় আলখেল্লা প্রাপ্ত। এরা নানাভাবে সমাজ শৃংখলা বজায় রাখার জন্য আধুনিকতা-পূর্ব ও আধুনিক সরকারগুলুকে সহযোগীতা করে আসছেন। ধর্মের পিতৃতান্ত্রিকতা তাই আজো বাংলাদেশের পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের চালিকা শক্তি। আমার পরিচয়, জাতি ও জাতীয়তাবাদেরর সাথে রয়েছে এ পিতৃতান্ত্রিকতার গভীর সম্পর্ক। ।
Posted on: Sat, 22 Jun 2013 05:08:58 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015