এ কে খন্দকার কেন এ বই - TopicsExpress



          

এ কে খন্দকার কেন এ বই লিখলেন সুভাষ সিংহ রায় হঠাৎ করে এ বইয়ের সংবাদে সবাই যেন বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়েছেন। তাঁকে সবাই সজ্জন বলেই জানেন। কিন্তু এই কাজটা তাঁর জন্য কি খুব জরুরি ছিল? আবার এই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, তিনি নিজে এই বই লিখেছেন কি না? তাঁর মতো মানুষ অন্যের লেখা বইয়ে নিজের নাম ব্যবহার করতে দেবেন? তাও ভাবতে কষ্ট হয়। এ কে খন্দকার সাহেব যা এ বইতে লিখেছেন, তা কখনোই প্রমাণ করতে পারবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় গোপন দলিল থেকে স্পষ্ট করে অনেক তথ্য জানা যায়। ইয়াহিয়া খান সব সময় বলেছেন, শেখ মুজিবের শক্তি বাঙালি জাতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঘিরে। এর বাইরে তাঁর করার কিছুই নেই। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়াশিংটনস্থ এশিয়ার নিকটপ্রাচ্য বিভাগের সহকারী সচিব জোসেফ জে সিসকো পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি রজার্স বরাবর নিচের গোপন তথ্যস্মারকটি পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার মুজিবের হাতে : ইয়াহিয়ার ঢাকা গমন- এই শিরোনামযুক্ত স্মারক বিবরণটি নানা কারণে আমাদের কাছে দারুণ বলে বিবেচিত হয়েছে। কী কী কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিতে হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ এতে তুলে ধরা হয়েছে। খন্দকার সাহেব, ভেতরে বাইরে বইতে ৩০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, শোনা যায়, মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্ররা নিজ উদ্যোগে পুরনো ৩০৩ রাইফেল নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছিল। আবার তিনিই প্রশ্ন তুলেছেন, যুদ্ধের জন্য কোনো রাজনৈতিক নেতাদের প্রস্তুতি ছিল না। আসলে খন্দকার সাহেব মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে অসমর্থ হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে নাকি বাঙালিরা শুধু অবাঙালিদের সম্পত্তি লুটপাট করেছে। এটা নাকি তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। অবশ্য প্রশ্ন করার আছে, তিনি তখন কোথায় ছিলেন? আর এটাকেই তিনি বলছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভেঙে পড়া। সবচেয়ে আপত্তিকর কথা বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উইনস্টন চার্চিল শত্রুপক্ষকে আকাশে, মাটিতে এবং জলরাশিতে আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন; তখন তাঁর সঙ্গে প্রবল শক্তিশালী মিত্রশক্তি ছিল। কিন্তু ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন সর্বাধুনিক অস্ত্র, যুদ্ধপ্রযুক্তি ও উন্নত কৌশলসমৃদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে। তাই তো শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আজ সারা পৃথিবীতে গবেষণা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য থেকে সম্প্রতি একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে- We shall fight on the beaches : the speeches that inspired history। এখানে The consequences শিরোনামে ভাষণের ব্যাখ্যাও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। Mujibur’s exhortation for a mass uprising led to swift, violent repercussions. He declared East Pakistan to be independent and the new state was called Bangladesh. শুধু ভাষণই প্রকাশ করা হয়নি, গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিগত ২৫০০ বছরের ইতিহাসে গোটা দুনিয়ার ৪১টি ভাষণের একটি সংকলন। সেখানে উপমহাদেশের একমাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ সেই বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে বায়োফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুটি সংগ্রামের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাথায় সব সময় থাকত, কোনোভাবেই বাংলাদেশ আন্দোলনকে যেন নাইজেরিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বায়োফ্রার সঙ্গে তুলনা করতে না পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব খুবই দক্ষতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশ আন্দোলন একটি সত্যিকার জাতীয় আন্দোলন ও একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে ৭ মার্চের জন্য ১৯৬৬ সাল থেকে প্রস্তুত করেছিলেন। এ কে খন্দকার সাহেবের বইতে অসংখ্য অসংগতি। উল্লিখিত বইয়ের ৩৬ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে- কচুক্ষেত তখন অনুন্নত উপশহর ছিল। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর কচুক্ষেতের সাধারণ মানুষ বাজারে কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে সেনানিবাসে বসবাসরত সামরিক ও বেসামরিক মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা সব সময় চোরাগোপ্তা আক্রমণের ভয়ে ভীত থাকত বলে দূরের কোনো বাজারে যেত না। তাহলে দাঁড়াল যে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ঠিকই পেয়ে গিয়েছিল। কেননা অন্তত পাঁচ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু একটু একটু করে দেশবাসীকে প্রস্তুত করেছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালি জাতি বুঝে নিয়েছিল, পাকিস্তান মৃত, স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। উল্লিখিত বইয়ের প্রায় সর্বত্র খুবই হালকা ধরনের খেলো যুক্তি দিয়েছেন। ৩২ পৃষ্ঠার এক জায়গায় লিখছেন- বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল জয় পাকিস্তান। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, জয় পাকিস্তান। এটি যে যুদ্ধের ডাক বা স্বাধীনতার আহ্বান, তা প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তর্কাতীতও নয়। যদি আওয়ামী লীগের নেতাদের কোনো যুদ্ধ-পরিকল্পনা থাকত, তাহলে মার্চের শুরু থেকে জনগণ এবং সরকারি, বেসরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের স্বল্পসময়ে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যেত। সেটা করা হলে আমার মনে হয় যুদ্ধটি হয়তো বা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেটা করা হয়নি। কী আশ্চর্যরকম অপব্যাখ্যা। আবার তিনিই লিখেছেন- ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-জনতা পাকিস্তানের পতাকা না উড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। ২২ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকরা বায়তুল মোকাররমে একটি বিরাট সমাবেশ করেন। তাহলে কি প্রমাণিত হয় যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল না? লেখক এ কে খন্দকার বইয়ের ৪০ ও ৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, সেই সময় পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বাসা ও আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেওয়া থাকত। প্রেসিডেন্ট বিমানে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে আমি বঙ্গবন্ধুর বাসার একটি টেলিফোন নম্বরে রিং করে ইয়াহিয়া খানের এই মাত্র ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সংবাদটি দিলাম। টেলিফোনের ওপার থেকে কে ফোন রিসিভ করেছিল, তা আমি জানতে পারিনি। কিন্তু গলার স্বর ছিল খুব গম্ভীর ও ভারী। আমি ফোনে কারো নাম ধরেও চাইনি। আর আমার পরিচয়ও তাকে বলিনি। তারপর আমি ক্যান্টনম্যান্টের ভেতরে চলে যাই। এই লাইন কটির মর্মার্থ কী? প্রথমত, মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব কতটা জনসম্পৃক্ত ছিল তার প্রমাণ দেয়। বঙ্গবন্ধুর বাসায় টেলিফোন রিসিভ করা ভদ্রলোকের গলার স্বর ছিল খুব গম্ভীর ও ভারী। এখানে কেন এ কে খন্দকার রহস্যময় উপস্থাপনে প্রবৃত্ত হলেন? মিরজাফরদের যুগে যুগে বাঙালি জাতির ভেতরেই দেখা গেছে। মোশতাক ও তাঁর সহযোগীরা সংগোপনে মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সব কিছু বিবেচনা করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার খন্দকার মোশতাক আহমদের যুক্তরাষ্ট্র বা বিদেশ সফর বাতিল করে। অনেকটা আকস্মিকভাবেই প্রতিনিধিদলের নেতা নির্বাচিত হন লন্ডনে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। একই সময় বাংলাদেশ সরকার আওয়ামী লীগের সব সদস্যকে বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলার পরামর্শ প্রদান করে। এ কে খন্দকার সাহেব বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে কোনো দিকনির্দেশনা পাননি। কিন্তু এ রকম একটি বই লেখার দিকনির্দেশনা কোথা থেকে পেলেন? এ কে খন্দকার সাহেব কি ভেবেছেন, এটাই মোক্ষম সময়? লেখক : কলামিস্ট
Posted on: Wed, 10 Sep 2014 04:16:44 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015