গৌরবোজ্জল - TopicsExpress



          

গৌরবোজ্জল ইতিহাস উপমহাদেশের রাজনীতির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির শক্ত অবস্থান, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনসমূহের রয়েছে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ভূমিকা। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির মাঝে পার্থক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার ধারাবাহিকতায় এখানে যেমন রয়েছে ভিন্ন আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ তেমনি রয়েছে অনেক দলের অঙ্গীভূত ছাত্রসংগঠন। বাংলাদেশের বুকে রয়েছে পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা ছাত্র সংগঠনসমূহ। তারই পাশাপাশি কাজ করছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা কতিপয় সংগঠন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে ওঠা, দলীয় লেজুড়বৃত্তিমুক্ত এক আলোকিত ছাত্রসংগঠনের নাম, একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে পথচলা শুরু করে একে একে ৩৫টি বছর পেছনে ফেলে এ সংগঠন রচনা করেছে এক গৌরবময় ইতিহাস। একটি গঠনমূলক গতিশীল গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে, একটি একক ও অনন্য অনানুষ্ঠানিক শিাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে, মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির জনতার মনে, লক্ষ তরুণের হৃদয়ে করে নিয়েছে তার স্থায়ী আসন। শিবিরের বিগত ৩৫ বছরের ইতিহাসকে বিভিন্নভাবে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই সংগঠনের অনেক রকম মূল্যায়ন হতে পারে, পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবেও হতে পারে অপর বিবেচনা। একটি অনন্য সংগঠনের প্রায় তিনযুগের ইতিহাস সত্যি সত্যিই সচেতন, নিরপেক্ষ ও যথার্থ বিবেচনার দাবি রাখে। একটি নিরন্তর সংগ্রামরত ছাত্রসংগঠন হিসেবে ৩৫ বছর ধরে অব্যাহত ধারায় কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির রচনা করেছে গৌরবময় ইতিহাস। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অনেক ঐতিহ্য। দেশ-জনতার সুবিবেচনার জন্য সে বিষয়গুলো তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। শিবিরের আত্মপ্রকাশ সময়ের অনিবার্য বাস্তবতা কোন প্রোপট ছাড়া যেমন কোন ঐতিহাসিক ঘটনা জন্ম নেয় না, তেমনি কোন প্রয়োজন ছাড়া সংগঠনেরও জন্ম হয় না। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠা ছিল তৎকালীন সময়ের এক অনিবার্য দাবি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সামগ্রিক প্রেক্ষাপট এ ধরনের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশকে অনিবার্য করে তোলে। ক. স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ী হয় মুক্তিকামী মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একটি স্বাধীন দেশ, একটি ভৌগোলিক মানচিত্র, একটি লাল-সবুজ পতাকা লাভ করলেও দেশের মানুষের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানকারী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত সহসাই আমাদের সাথে ‘দাদাগিরি’ শুরু করে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে চলে যেতে থাকে আমাদের দামী দামী সম্পদরাজি। প্রতিবাদ করার অপরাধে দেশের প্রথম রাজনৈতিক বন্দী হন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ. জলিল। অল্প সময়ের মাঝেই দেখা দিলো দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাংস্কৃতিক দেওলিয়াত্ব। সামগ্রিক অরাজকতা অতি অল্প সময়ের মাঝে দেশটির স্বাধীনতাকে এক ধরনের পরাধীনতায় রূপান্তরিত করলো। যাকে প্রখ্যাত গবেষক আবুল মনছুর আহমদ বললেন “বেশি দামে কেনা, কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা”। ৭১ থেকে ৭৫ এর সাড়ে তিন বছর সময়কাল। এ সময়ের মাঝেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো একদলীয় স্বৈর সরকার ‘বাকশাল’। সকল দলের, সকল মতের টুঁটি চেপে ধরা হলো। ইসলামের নামে যে কোন দল বা সংগঠন করা নিষিদ্ধ হলো। সরকার নিয়ন্ত্রিত ৪টি পত্রিকা ছাড়া সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হলো। কালা-কানুনের যাঁতাকলে পিষ্ট হলো মানুষ। হারালো বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। ৩০ হাজার তরুণ প্রাণ দিলো প্রতিবাদ করতে গিয়ে। দেশ চলে গেলো “এক নেতা এক দেশ” শ্লোগানধারী একদল উচ্ছৃঙ্খল ও জিঘাংসু বাহিনীর কবলে। হাতে বালাশৃঙ্খল পরিহিত এই সব উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা প্রশাসন নামক কুশাসনের ছত্রছায়ায় সর্বত্র জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুললো। সামগ্রিক এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের কান্নার অধিকারও যেনো হারিয়ে গেলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে জীবন দিলো, কাপড়ের অভাবে বাসন্তীরা ছেঁড়া জাল জড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করতে বাধ্য হলো, মানুষে-কুকুরে কাড়াকাড়ি করলো ডাস্টবিনের উচ্ছ্বিষ্ট খাবার নিয়ে। ক্ষমতাশীনদের সন্তান-সন্ততিরা উঠে গেলো আইনের ঊর্ধ্বে। নিরীহ মানুষেরা শিকার হতে লাগলো কালো আইনের কঠোর থাবার। খ. সোনার বাংলার স্বপ্ন : সোনার মানুষের অভাব বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এক স্বপ্নের দেশ। এক সময় এ দেশে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেতো। এখানে ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর গৃহ ভরা স্নেহপ্রীতি। তাই এই বাংলাকে বলা হতো ‘সোনার বাংলা’। বারবার ঔপনিবেশিক শাসন, বর্গীদের হানা এই বাংলার জনপদের সুখ-সমৃদ্ধি ও স্থিতি ছিনিয়ে নেয়ার অপপ্রয়াস পেয়েছে। সেজন্য যারাই মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছে তারাই বলেছে আমরা সোনার বাংলা কায়েম করবো। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামেও এ কথা বলেই আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মনে আশার আলো জাগানো হয়েছিলো, মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিলো কারা? সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই বললেন- “মানুষ পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে সর্বত্র চোর। সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল এসেছে- আমার কম্বল কই?” একটি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা যতো সহজ তা বাস্তবায়ন তত সহজ নয়। এজন্য চাই একদল সোনার মানুষ। সৎ, সত্যনিষ্ঠ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক একদল মানুষ -যাদের মূল্য হবে স্বর্ণের চেয়ে বেশি। এমন একদল মানুষ ছাড়া কিভাবে সম্ভব এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন? মূলত মানুষ তৈরী হয় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। আম খেতে হলে যেমন আমগাছের চারা লাগাতে হয়। তেমনি একদল সোনার মানুষ তৈরীর জন্য উপযুক্ত একটি শিা ব্যবস্থার প্রয়োজন। বিগত প্রায় সোয়া দুইশত বছর পর্যন্ত আমরা ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মেনে চলছি। একজন খোদাভীতি সম্পন্ন, সত্যনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক যোগ্য লোক তৈরি করা -অন্তত এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। এই ছিল যখন বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রোপট তার সাথে যুক্ত হলো ১৯৭৫-এর ঐতিহাসিক পট-পরিবর্তন। এ সময় সপরিবারে নিহত হলেন দেশের স্বাধীনতার নায়ক, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান- যিনি আবার ছিলেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এতবড় একটি বিয়োগান্তক ঘটনায় সাধারণ মানুষকে কাঁদতে দেখা যায়নি। উল্টো তারই সতীর্থ সহযোগীগণ মতায় বসলেন। অল্প সময়ের মাঝে ঘটে গেল অনেক ঘটনা। সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিভিন্ন ধাপ গড়িয়ে দেশটি এক অদ্ভূত অবস্থানে চলে এলো। হতাশাকিষ্ট সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পারছিলেন না কী হবে এই দেশের ভবিষ্যত? এমনি প্রোপটে বাংলাদেশের কতিপয় চিন্তাশীল ও সাহসী তরুণ মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তরুণ ছাত্রসমাজকে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়ে একটি আদর্শবাদী ছাত্রসংগঠনের জন্ম দেয়ার জন্য। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে তাদের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হলো শান্তিকামী ছাত্র-তরুণদের প্রিয় কাফেলা “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” এর। শুরু হল একটি সুমধুর সঙ্গীতের শপথদীপ্ত অনুরণন – “পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে আমরা শিবির গড়েছি শপথের সঙ্গীন হাতে নিয়ে সকলে নবীজীর রাস্তা ধরেছি” বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসাবে ঠিক করলো ‘‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা:) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহ’র সন্তোষ অর্জন”। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দ্বীন কায়েমের লক্ষে শিবির ঠিক করলো পাঁচ দফা কর্মসূচি। নবী-রাসুলদের আন্দোলনের ইতিহাসকে সামনে রেখে শিবির তিনদফা স্থায়ী কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ করলো দাওয়াত, সংগঠন ও প্রশিণের কর্মসূচি। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রোপটকে সামনে রেখে গ্রহণ করলো শিাব্যবস্থা ও শিা আন্দোলন এবং সামগ্রিক ইসলামী জীবনাদর্শের কর্মসূচী। এভাবেই শিবির স্থির করলো তার ৫ দফা বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা ঘোষণা এ যেন ছিলো ঘনঘোর অন্ধকারে হঠাৎ আলোর ঝলকানি। হতাশা ও নিরাশার মাঝে এক শুভ্র আলোর হাতছানি। এ সংগঠন সবার প্রাণে ছড়িয়ে দিলো আশা ও সম্ভাবনার নতুন দীপ্তি। অতি অল্প সময়ের মাঝেই দেশের ইসলামপ্রিয় ছাত্র তরুণদের একক কাফেলায় পরিণত হয় শিবির। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা-কর্ণফুলীসহ নাম না জানা অসংখ্য নদীর বাঁকে বাঁকে, শহরে, বন্দরে, নগরে, গ্রামে-গঞ্জের প্রতিটি জনপদে ছড়িয়ে পড়লো একটি হিল্লোল, একটি নাম- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। শিবিরের অনুপম কর্মসূচি, আল্লাহর পথে সাধারণ ছাত্রসমাজকে উদারভাবে আহবান, সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত ভ্রাতৃত্বের বন্ধনময় সংগঠন গড়ে তোলা, সংগঠিত ছাত্রদের জ্ঞান-চরিত্র ও মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ সুন্দর মানুষে পরিণত করা, ছাত্রদের অধিকার রা ও ক্যারিয়ার গঠনে সহযোগিতা প্রদান আর যাবতীয় শোষণ, নিপীড়ন ও গোলামী থেকে তাদের মুক্তির প্রয়াস শিবিরকে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আল্লাহ্র রাহে কোরবানির মানসিকতা সম্পন্ন একদল জিন্দাদিল তরুণ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। এসব তরুণদের কোন পিছুটানই ধরে রাখতে পারে না, পারে না লোভ-লালসা, দুনিয়াবী আকর্ষণ এদের কান্ত করতে। ঘরের টান বড় নয়, বড় এদের কাছে খোদার পথে নিরন্তর সংগ্রামের আহবান। এদেরই গান “আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনে ছেলে আর, আমি বলি খোদার পথে হোক এ জীবন পার।” শিবিরের নেতা-কর্মীদের এই নিরলস নিরাপোষ চেষ্টাই সংগঠনকে ৩৫ বছরের মাঝে দিয়েছে এক অনন্য সাধারণ মজবুত ভিত্তি। শিবির এক বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা একজন ছাত্রকে দুনিয়ায় চলার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কলা-কৌশল শিা দেয়। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কোরআন-হাদিসের আলোকে দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর মানুষ এবং আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি ছাত্র তীব্র প্রতিযোগিতার মানসিকতা সম্পন্ন একজন দয়ামায়াহীন, দায়িত্ববোধহীন ভোগবাদী মানবে রূপ নেয়। তার ভেতর মানবতা, কল্যাণব্রত, খোদাভীতি ও জবাবদিহিতা জন্ম নেয় না। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিগত ৩৫ বছরের শ্রমনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে আজ অবধি পরিপূর্ণ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন না হলেও বাংলাদেশ প্রতি বছর সমৃদ্ধ হচ্ছে একদল আলোকিত মানুষের মাধ্যমে। লাভ করছে একদল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষ। শিবির তার কর্মীদেরকে একটি সুন্দর সমন্বিত সিলেবাসের মাধ্যমে গড়ে তোলে। প্রতিটি কর্মীকে নিয়মিত রিপোর্ট রাখতে হয়। প্রতিদিন তাকে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ আল কুরআনের কিছু অংশ অধ্যয়ন করতে হয়। অধ্যয়ন করতে হয় এক বা একাধিক হাদীস, ইসলামী সাহিত্যের কমপে ১০টি পৃষ্ঠা, তাকে পত্র-পত্রিকা পড়তে হয়। প্রতিদিনই তাকে দিনশেষে নিজের কৃতকর্ম নিয়ে আত্ম-সমালোচনা করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা এসব অধ্যয়নকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে হয়। তাকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে আদায় করতে হয়। এভাবে শিবির প্রতিটি তরুণকে জ্ঞানে ও চরিত্রে একজন সমন্বিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়। শিবিরের প্রতিটি কর্মীকে প্রতিদিন কমপে ৩ ঘন্টা পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নের জন্য তাগিদ দেয়া হয়। সংগঠনের প থেকে পড়ালেখার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিশেষভাবে দেখা হয় : শিবির প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষার জন্য গাইড ও কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থা করছে। শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলো ও ভর্তি গাইডসমূহ ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে সর্বাধিক বিশ্বস্ত এবং কার্যকর। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের সেরা শিক্ষক ও ছাত্রগণ এসব কোচিংয়ে কাস নিয়ে থাকেন। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয় বরং ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি উপযোগী করে গড়ে তোলার জনকল্যাণমূলক মনোভাব নিয়ে এসব কোচিং পরিচালিত হয়। মেধাবী, অসচ্ছল ও দরিদ্র শিার্থীদেরকে স্বল্প ফি, এমনকি প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বিনা ফিতেও কোচিং করানো হয়। শিবির মেধাবী ও কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত সংবর্ধনা প্রদান করে উৎসাহিত করে থাকে। গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য শিবিরের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বৃত্তির ব্যবস্থা। মেধার সুষ্ঠু ও সঠিক বিকাশ ঘটাতে তার স্বীকৃতি অপরিহার্য। বিষয়টিকে যথাযথ বিবেচনায় রেখেই শিবির মেধাবী ও কৃতি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত সংবর্ধিত ও উৎসাহিত করছে। স্থানীয়ভাবে শাখাসমূহ আয়োজন করে ৫ম ও ৮ম শ্রেণীর বৃত্তিপ্রাপ্তদের সংবর্ধনা। জাতীয় ও স্থানীয় বিশিষ্ট মেহমানদের উপস্থিতিতে এস.এস.সি/দাখিল, এইচ.এস.সি/ আলিম পরীক্ষায় অ+ প্রাপ্তদের নিয়ে আয়োজন হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে পরিচালিত ফ্রি কোচিং এবং বিনামূল্যে পুস্তক সরবরাহ কর্মসূচির সহায়তায় আজ বহু কৃতি ছাত্র ভাল ফলাফল করতে সম হয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে যাচ্ছে ধূমপান, মাদকতা ও পরীক্ষায় নকলমুক্ত এক অনাবিল সুন্দর জীবনের পরশ। শিবিরের কর্মীগণ নিজেরা যেমন এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, তেমনি তারা অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে এ ধরনের পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও অনুসরণীয় জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ধূমপান বিরোধী যে আইন পাশ করেছে শিবির তা বাস্তবায়ন করে আসছে বিগত ৩৫ বছর ধরে। যাত্রার শুরু থেকেই শিবির তার প্রতিটি কর্মীকে অভ্যস্ত করেছে নকলমুক্ত পরীক্ষায়। শিবির তার কর্মীদের মাঝে আল্লাহ-প্রেম ও খোদাভীতি সৃষ্টির জন্য তাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলে শব্বেদারী বা নৈশ ইবাদাতে যা তাদেরকে তাহাজ্জুদ আদায়ে অনুপ্রাণিত করে। প্রতিভার লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে শিবির বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির কেবল প্রতিভা বিকাশ ও লালনের কাজই করে না বরং শিবির হচ্ছে প্রতিভা সন্ধানী একটি অনন্য সংগঠন। ছাত্রদের সুপ্ত প্রতিভা সন্ধানের জন্য শিবির প্রতি বছর তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আয়োজন করে বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতা, মেধা যাচাই, ক্যারিয়ার গাইডলাইন কনফারেন্স, কম্পিউটার মেলা, বিজ্ঞান মেলা, সাধারণ জ্ঞানের আসর, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, ক্রিকেট ও ফুটবল প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এছাড়া শিবির আয়োজন করে থাকে আন্তঃস্কুল, আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজন যেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে মেধাবী তরুণদের, তেমনিভাবে বের করে আনে প্রতিভাসমূহকে, যারা গড়ে তুলবে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের একমাত্র ছাত্রসংগঠন যার রয়েছে নিয়মিত প্রকাশনা। সকল পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে শিবিরের কেন্দ্রীয় মাসিক ছাত্র সংবাদ, সাময়িকী youthwave। এসব পত্রিকায় লিখে যাদের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল তাদের অনেকেই আজ দেশের খ্যাতনামা কবি,সাহিত্যিক। এছাড়া শিবিরের বড় বড় শাখাগুলোর প্রায় প্রতিটিরই রয়েছে নিজস্ব নিয়মিত প্রকাশনা। বড় শাখাগুলো মাসিক ও ত্রৈমাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করছে। অপসংস্কৃতির সয়লাবে ভেসে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের নিয়ে সবাই যখন উদ্বিগ্ন অথচ কোন কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ তখন ‘‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” গ্রহণ করেছে কার্যকর কর্মসূচি। আজ ৩৫ বছর শেষে শিবির তৃপ্ত। কারণ তার রয়েছে সারাদেশে সর্বজনস্বীকৃত ২০০টিরও বেশি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠী নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কসপ ও প্রযোজনার মধ্য দিয়ে একঝাঁক তরুণ শিল্পী তৈরী করে যাচ্ছে প্রতি বছর। মঞ্চ অনুষ্ঠান ছাড়াও এসব গোষ্ঠীর রয়েছে নিয়মিত অডিও ভিডিও প্রকাশনার বিপুল সম্ভার। আর এসব ধারণ করে আছে- ইসলামী গান, দেশাত্মবোধক গান, জারী, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালী গান। রয়েছে আবৃত্তি, নাটক, কৌতুকের সমাহার যা একজন দর্শক শ্রোতাকে নির্মল আনন্দ ও ইসলামী মূল্যবোধের যৌথ আস্বাদ দান করে থাকে। ১৯৯৪ থেকে শিবির গড়ে তুলেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি সংগঠনসমূহের ফোরাম। এই ফোরাম আয়োজন করে প্রশিণের, উৎসবের। আর প্রকাশ করে যাচ্ছে অসংখ্য অডিও-ভিডিও ক্যাসেট ও সিডি। একটি নতুন ধারার নাট্য ও চলচ্চিত্র আন্দোলনও দিন দিন এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের আধুনিক শিতি তরুণদের মাঝে ইসলামী আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে শিবিরের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। সবার মাঝে সালামের প্রচলন এসবের একটি। বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করা শিবিরের কালচার। এছাড়া শিবির ঈদকার্ড ও শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের প্রচলন করেছে। শিবির সববয়সীদের জন্য প্রকাশ করছে চমৎকার সব পোস্টার, স্টিকার, ভিউকার্ড, পোস্টকার্ড, কাস রুটিন, রমজানের সময়সূচি, নববর্ষের ডায়েরী, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। এছাড়া বিজ্ঞান শিাকে আকর্ষণীয় করার জন্য সায়েন্স সিরিজ সহ অন্যান্য প্রকাশনা। ২০০০ সাল থেকে শিবির প্রকাশ করছে তিন পাতার বিষয় ভিত্তিক বড় ক্যালেন্ডার। এই দুর্যোগে, দুর্ভোগে আজ, জাগতেই হবে জাগতেই হবে তোমাকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগ কবলিত জনপদ। ইতিহাসের ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করে টিকে আছে এদেশের মানুষ। নিজের জীবন রার পাশাপাশি অন্যদের সাহায্যে ছুটে যাওয়া এখানকার মানুষের চিরাচরিত নিয়ম। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির জাতির এসব ক্রান্তিকালে রেখেছে সাহসী ও উদার ভূমিকা। ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার সময় সারাদেশ থেকে ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামসহ দণি অঞ্চলের সাইকোন-পীড়িত জনতা শিবির কর্মীদের ত্যাগ ও সহযোগিতার কথা কখনো ভুলবে না। খরা কবলিত উত্তর জনপদ, মহামারী আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকায় শিবিরের ত্রাণ ও মেডিকেল টীমের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০১ এর প্রলয়ংকরী বন্যার পর শিবিরের ত্রাণবিতরণ কর্মসূচি সবাইকে অভিভূত করেছে। ২০০৭ এ সিডরে তিগ্রস্থ দণিাঞ্চলের জনপদে শিবির কেবল ত্রাণ বিতরণ করেনি বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করেছে আটকে পড়া দুর্গত মানুষদের। একই ভাবে ২০০৯ সালে পটুয়াখালী, সাতীরা ও খুলনা এলাকার আইলা আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ায় শিবির। ছাত্র সংগঠন হিসেবে শিবির এসব দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তিগ্রস্ত ছাত্র- ছাত্রীদের শিক্ষা সাহায্যের দিকে। ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম সহ নগদ অর্থ প্রদান করে তাদের শিাজীবনকে অব্যাহত রাখা ছিল শিবিরের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি। শীতার্তদের মাঝে প্রায় প্রতি বছরই শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচী পালন করে শিবির। শিবিরের নিয়মিত কর্মসূচির মাঝে রয়েছে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, বৃরোপণ কর্মসূচীর মত সামাজিক আন্দোলন কর্মসূচি যা সুন্দর ও নির্মল সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাতীয় ইস্যুসমূহে শিবিরের ইতিবাচক ভূমিকা একটি ছাত্রসংগঠন হিসেবে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যু ও ক্রান্তিলগ্নে এ সংগঠন রেখে এসেছে ইতিবাচক ভূমিকা। ১৯৮১ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর মতাসীন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ১৯৮২ সালে বন্দুকের নলের মুখে সরিয়ে দিয়ে মতা দখল করে স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা ছিল অগ্রণী ও বলিষ্ঠ। নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টি.এস.সি, শাহবাগ ও দোয়েল চত্বর কেন্দ্রিক যে বিশাল ছাত্রজমায়েত ও আন্দোলন গড়ে উঠে তার অন্যতম সংগঠক ইসলামী ছাত্রশিবির। শিবিরের বহু নেতা-কর্মী স্বৈরশাসকের হাতে নিহত ও বন্দী হলেও শিবির মুহূর্তের জন্যও ঘাবড়ে যায়নি। শিবিরের বিশাল সমাবেশ ও মিছিল ছাত্র জনতার প্রাণে নতুন আশা ও প্রেরণা সঞ্চার করেছে। স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের প্রধান নিয়ামক শক্তি ছিল ছাত্রদের গড়ে তোলা আন্দোলন, আর সে আন্দোলনের অন্যতম শরিক ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৯২ সালে শিবিরকে রাখতে হয়েছে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা -যা বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। গণআদালতীদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে শিবির ছিল ময়দানের লড়াকু শক্তি। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির এক মহাক্রান্তিকাল। ১৯৯৬-এর নির্বাচনের মাধ্যমে মতায় আসা দলটি পর্যায়ক্রমে একদলীয় স্বৈরাচারে রূপ নিলে দেশের অন্যসব ছাত্র সংগঠনসহ শিবির গড়ে তোলে “সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য” -যার নিরলস প্রয়াসে দেশ ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে শিবিরের ভূমিকা ছিল প্রচণ্ড প্রত্যয়দীপ্ত, পরিশ্রমী ও আত্মত্যাগী। বিষয়টি সর্বজনবিদিত ও প্রশংসিত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যতো রকম সন্ত্রাস, রাহাজানি ও দেশদ্রোহী কাজ রয়েছে, শিবির বার বার তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। শিবির নিজে যেমন দলের মাঝে সন্ত্রাসীদের কোন স্থান রাখেনি তেমনি কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকেই শিবির প্রশ্রয় দেয় না। বারবার বোমা, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে, তখন প্রতিপরে কেউ কেউ শিবিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেও শিবির যে এসব অপরাধ থেকে বহু বহু দূরে তা প্রমাণ করতে পেরেছে। ২০০৫-এ শিবির সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে গড়ে ওঠা অস্থিতিশীল ও দোদুল্যমান পরিস্থিতি এবং ৬৩ জেলায় চেইন বোমা হামলার ঘটনার পর দেশের সচেতন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী, শিাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের নিয়ে আয়োজন করেছে গোলটেবিল বৈঠকের। এ আয়োজন ও আলোচনা দেশ ও জাতিকে নতুন আশায় উজ্জ্বীবিত করেছিলো। ১৯৯৯ সালে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে শিবির তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে তথাকথিত শান্তিচুক্তির নামে মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করার অবিমৃষ্যকারীতার বিরুদ্ধে গণচেতনা সৃষ্টি, আত্মঘাতী ট্রানজিট ইস্যুতে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন, বিতর্কিত কুদরত-ই-খুদা শিা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের নামে ধর্মহীন সেক্যুলার শিা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সরকারী উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ প্রতিটি জাতীয় ইস্যুতে শিবিরের ভূমিকা ছিল স্ফটিকস্বচ্ছ। শিবির সন্ত্রাসকে একটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করে সারাদেশে সন্ত্রাস বিরোধী জনমত গঠন, সন্ত্রাস দমন ও সন্ত্রাস নির্মূলের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্ষেত্রে শিবির সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, র‍্যালী আয়োজন ছাড়াও সকল উদ্যোগে সর্বোত্তম সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটদল ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১ দিনের ম্যাচে জয়ী হলে শিবির নেতৃবৃন্দ বিজয়ী দল, কোচ ও তার কর্মকর্তাদের অভিনন্দিত করে বিবৃতি প্রদান করেন। এশিয়ান হাইওয়ের নামে ট্রানজিট Asian Highway Ges Trans-Asian Railway হলো United Nation-এর অঙ্গ সংগঠন। ESCAP-এর পরিকল্পনায় প্রথমে ১৫টি দেশের কথা বলা হলেও পরে এই মহাসড়কের গতিপথ ২০টি রাষ্ট্র হবে বলে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে ৩২টি রাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করা হয়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্যে বলা হয় এশীয় রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে ঐ দেশগুলোর মধ্যে সহজ ও দ্রুত বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষে বিভিন্ন এশীয় রাষ্ট্রের রাজধানীগুলোকে একই সড়ক ও রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ঊঝঈঅচ-এর মূল প্রকল্পের আওতায় পশ্চিম এশিয়া তুরস্কের ইস্তাম্বুল আঙ্কারা থেকে শুরু করে Asian highway কে শুধুমাত্র সড়কের মাধ্যমে ইরানের তেহরান, আফগানিস্তানের কাবুল, পাকিস্তানের লাহোর ও পরে শেরশাহের ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের মাধ্যমে ভারতের দিল্লি হয়ে বাংলাদেশের ঢাকা-চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের আকিয়াব এবং রাজধানী ইয়াংগুন হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের কথা ছিল। চীনকে কৌশলে এশিয়ান হাইওয়ে থেকে বাদ দিতে না পারলে এশিয়ায় ভারতের শক্তিশালী কর্তৃত্ব কায়েম হবে না, আমেরিকার কথা কেউ শুনবে না। অন্য দিকে বাংলাদেশ চীনের সাথে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে গভীর সম্পর্কে আবদ্ধ হবে যা বর্তমান সময়ের দাবি হওয়া উচিত। তাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবেও ব্যাপক লাভবান হতো। চীন এই মহাসড়কে যুক্ত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ভারতের হিংস্র থাবা থেকে অনেকটা মুক্ত থাকত। কিন্তু ভারতের মাথা ব্যথা হলো চীন যদি বাংলাদেশের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে তাহলে ভারতের কর্তৃত্ব বাংলাদেশের ওপর রাখতে পারবে না। যা আমেরিকা ও ভারত কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ভারতের সাথে আমেরিকার সাম্প্রতিক সময়ের পরমাণু চুক্তি, তাদের সম্পর্ককে অত্যন্ত গভীর করেছে। যার জন্য ভারত যাতে অংরধহ ঐরমযধিু-র মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে Seven Sister States -এ তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে যেতে পারে সে জন্য আমেরিকা ভারতের হয়ে চাটুকারিতা করছে। Transit আমাদের জন্য যা তিকর, তার চেয়ে অনেক বেশি তি করবে ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাতবোন রাজ্যে যাওয়ার নতুন মহাসড়ক Asian Highway । সামান্য যা অর্থ পাওয়া যাবে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খরচ করতে হবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের সীমান্তের প্রায় ১০৫০ কিলোমিটার বা ৬৫০ মাইল রাস্তা যার নির্মাণ খরচ বহন ও রক্ষনের দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশকে পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই ছাত্রশিবির দেশকে তাঁবেদার বানানোর এই নয়া ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি: সেনা প্রত্যাহার পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে ভারত সহজেই চট্টগ্রাম বন্দর পেয়ে যাবে। এই লোভে শান্তিবাহিনী ও জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাকে ভারত অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষন দিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে। সরকার পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে অন্যদিকে স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিলেন সন্তু লারমা (নয়া দিগন্ত ১০.০৮.০৯)। ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে এ দেশের সরকার ও জনগণকে সচেতন করতে কর্মসূচি নিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সন্তু লারমার স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বকে ঝুঁকির সম্মুখীন করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশে সন্ত্রাসে মদদদান অন্যতম বিতর্কিত একটি বিষয়। ভারতের অভিযোগ হলো, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালনায় সাহায্য করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ দাবি করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে এই রকম ৩৯টি ঘাঁটি রয়েছে ভারতে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীর ৪৫টি সশস্ত্র ক্যাম্প খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের সন্নিকটস্থ বর্ডারিং এরিয়ায় ভারতে অবস্থিত। একইভাবে বঙ্গভূমি আন্দোলনেও বঙ্গসেনাদের ভারত সরাসরি মদদ দানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ছাত্রশিবির দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সন্ত্রাসের এই মরণখেলা থেকে উত্তরণ চায় এবং অব্যাহতভাবে এর বিরোধিতা করে আসছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ভারত বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন ঠেকানোর অজুহাতে বাংলাদেশ ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। এই কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের অবন্ধুত্বসুলভ নির্মম আচরণ প্রকাশ পায়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভারত বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায় না, চায় বাংলাদেশকে আবদ্ধ করে রাখতে। ভারতের এই আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী কাজের জন্য ছাত্রশিবির দেশবাসীকে সাথে নিয়ে প্রথম থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ভারত ১৩৫৭ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। তা ছাড়াও ভারতের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৪২৯.৫ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। এই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় মতার উদ্ধত রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। আর এর জের ধরে মিয়ানমারও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কাজে মনোযোগী হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের সাথে নতুন করে এখন মিয়ানমার যোগ হলো। ফলে একসাথে দু’টো দেশকে এখন পর্যবেণে রাখতে হবে যা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি। ছাত্রশিবির চায় অনতিবিলম্বে উভয় দেশের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে এহেন কাজ হতে বিরত রাখুক বাংলাদেশ সরকার। ২৮ অক্টোবর ২০০৬: রক্তের হোলি খেলা ও লগি বৈঠার তাণ্ডব মতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে যখন নির্দলীয় ও নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে মতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় জোট সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের পদত্যাগ ও সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে এম হাসানের পরিবর্তে বিচারপতি মাহমুদুল আমিনকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার দাবিতে আন্দোলনের শুরু করে। ২৮ অক্টোবর ২০০৬-এ চারদলীয় জোট যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে মতা হস্তান্তর করার কথা, তার পূর্বমুহূর্তে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে তাদের সর্বশেষ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশে শেখ হাসিনার নির্দেশে লগি-বৈঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা। ঢাকার রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো হত্যা ও আহত করে জামায়াত ও শিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মীকে। ঐ দিন ঐ সমাবেশে ঘটনাস্থলেই নিহত হন জামায়াত-শিবিরের ৫ জন কর্মী। দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব। এ তাণ্ডবে সারা দেশে হতাহত হয় অসংখ্য মানুষ। টিভি পর্দায় লগি-বৈঠার এ তাণ্ডব দেখে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়ে যায়। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে চরম বিশৃঙ্খলা। এ বিশৃঙ্খলার কারণে বিচারপতি কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে সংবিধানের সর্বশেষ অপশন হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। কিন্তু আওয়ামী লীগ ইয়েস উদ্দিনের সরকার বলে তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও ২২শে জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিল। অথচ শেষ মুহূর্তে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনায় মনোনয়ন প্রত্যাহার করে অযথা জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করলে দেশের সার্বিক অবস্থা চরম অবনতির দিকে এগিয়ে যায়। সরকারের অংশীদার হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রশিবির ২৮ অক্টোবর জামায়াতের পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রামকে সফল করার জন্য পল্টন ময়দানে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু চরম পরিণতি বরণ করতে হলো তাদের। এ সময় দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে আধিপত্যবাদী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা অপরদিকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী কুশীলব এবং এ দেশীয় কিছুসংখ্যক আত্মবিক্রীত বুদ্ধিজীবীর ষড়যন্ত্রের ফলে ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক, ছায়া সেনা সরকারের আবির্ভাবের প্রোপট রচিত হয়। পিলখানা ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শান্তি ধ্বংসের যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তারই ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় বিগত ২৫-২৬শে ফেব্র“য়ারি ২০০৯-এ বিডিআর সদর দফতরে ‘পিলখানা ট্র্যাজেডি’। এ মর্মান্তিক ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে নিহত হন ৫৮ জন চৌকষ সেনা কর্মকর্তা। পৃথিবীর ইতিহাসে বিনাযুদ্ধে এমনকি রণক্ষেত্রেও এত বড় হত্যা অভিযান হতে দেখা যায়নি। কারণ হিসেবে অসাংবিধানিক সেনা সমর্থিত তিন উদ্দিনের সরকারের (ইয়াজউদ্দিন+ফখরুদ্দিন+মঈন উদ্দিন) সময় রিলিফ ও ন্যায্যমূল্যের নিত্যপণ্য বিক্রির ঘটনাকে দায়ী করা হলেও সবাই কম-বেশি জানেন এটি ছিল অবিমৃষ্যকারী ষড়যন্ত্রীদের এক মারাত্মক নীল-নকশা। এ ছিল বাংলাদেশের প্রতিরাকে তছনছ করার এক গভীর ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির পিলখানা ট্র্যাজেডি ও বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে। নিহত সেনা সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়ার আয়োজন করে। দোষীদের আটক ও শাস্তি বিধানের দাবিতে মানববন্ধন, নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করে তাদের পাশে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক ইস্যুতে শিবির শিবির আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সব সময়ই নীতিগতভাবে কারো প্রতি শত্রুতা নয় বরং সকলের প্রতি বন্ধুত্বের ব্যাপারে সচেতন। তবে অন্যায় ও অবিচারের ব্যাপারে শিবির আপসহীন, জালেমের বিরোধিতা ও মজলুমের পক্ষ নেয়া শিবিরের নৈতিক দায়িত্ব। ১৯৭৯ সালে রাশিয়া তার পুতুল সরকার বারবাক কারমালের সহযোগিতায় স্বাধীনচেতা আফগান মানুষের স্বাধিকার কেড়ে নিয়ে সেখানে নগ্ন হামলা চালালে শিবির ঢাকায় ২০ হাজার তরুণের বিশাল মিছিল করে তার প্রতিবাদ জানায়। শিবির এভাবেই প্রতিবাদের মাধ্যমে ফিলিস্তিনী বীর যোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে আসছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আয়োজিত ১৯৯১-এর তেহরান কনফারেন্স- এ শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি যোগদান করেন। আন্দোলন সংগ্রাম ও পুনর্গঠনে শিবির ফিলিস্তিনী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার প্রদান ও রক্ষা করেছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, জাতিসংঘ প্রস্তাবিত গণভোট ও অন্যান্য প্রসঙ্গে শিবির কাশ্মীরী জনগণের পক্ষ নিয়ে বরাবরই ভূমিকা রেখে আসছে। অধিকৃতদদ কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণেরতীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে শিবির ১৯৮৯ সাল থেকেই কর্মসূচি দিয়ে আসছে। বসনিয়া হার্জেগোভিনায় মুসলিম জনপদের উপর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ ও দমন নীতির প্রতিবাদে শিবির আয়োজন করে র‍্যালি, সমাবেশ ও প্রতিবাদ সভা। সার্ব শাসক ও সেনাগোষ্ঠীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি ছিল এসব কর্মসূচির লক্ষ্য। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে ব্লাসফেমী আইনের পে জনমত গঠন করে। বিশেষ করে কুখ্যাত লেখক সালমান রুশদীর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিরুদ্ধে শিবির দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে। কুখ্যাত কবি দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিনসহ যারাই আল্লাহ্, রাসূল (সা.) ও ধর্মের ব্যাপারে অনর্থ কুৎসা রচনা করেছে তাদের ব্যাপারেই শিবির প্রতিবাদ কর্মসূচী দিয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলেছে। ১৯৯১ সালে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের ব্যাপারে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিবাদকারী ছাত্র সংগঠন ছিল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। পরবর্তীতে আফগানিস্তানে ও ইরাকে বৃহৎশক্তির নির্লজ্জ হামলা, সাধারণ মানুষদের হত্যা করা, শিশুদের নির্বিচারে খুন করার প্রতিবাদে শিবির ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। জনমত তৈরি, মিছিল, সমাবেশ, পোস্টারিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে কাপুরুষোচিত হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে সেখানকার নিহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে এবং বিশ্ব শান্তির প নিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে (১৯৯১) উগ্রবাদী হিন্দুগণ সে স্থানে রামমন্দির নির্মাণের অন্যায় আবদার করলে শিবির তার তীব্র প্রতিবাদ জানায় ও ব্যাপক জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে। একইভাবে আহমেদাবাদে দাঙ্গা সৃষ্টি ও নির্বিচারে মুসলিম নিধনের প্রতিবাদ করে শিবির। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের একদল সুযোগসন্ধানী এদেশে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইলে শিবির অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের নিয়ে “শান্তি মিছিল” বের করে এবং বিভিন্ন স্থানে অমুসলিম উপাসনালয় পাহারার দায়িত্ব পালন করে। এ ভূমিকা হিন্দু সুধীজনের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। ২০০৫ সালের ৭ জুলাই ব্রিটেনের পাতাল রেল এবং গাড়িতে বোমা হামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অবস্থিত ব্রিটিশ হাই কমিশনারের বাসায় সংরতি শোক বইতে সমবেদনা জ্ঞাপন ও শোক প্রকাশ ও হামলার নিন্দা করে স্বার করেন শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি। সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজীজের মৃত্যুতে সৌদি দূতাবাসের শোক বইয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি স্বাক্ষর করেন। একইভাবে আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশে হারিকেন ক্যাটরিনা ও রিটার আঘাতে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত, তাদের আত্মীয়-স্বজনের প্রতি সমবেদনা জানান কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। আন্তর্জাতিক সভা, সম্মেলন, সেমিনারে ছাত্রশিবির বিশ্ব ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী ছাত্রসংগঠন হিসাবে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট নিরসনে আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশে শিবিরের প্রতিনিধি উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। WAMY, IIFSO, AFMY সহ আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহে শিবির প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় ছাত্রশিবির বিশ্বদরবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ছাত্রসংগঠন। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব, সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে ইসলামী ছাত্রশিবির দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা পালন করে। আশির দশকের গোড়ার দিকে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় World Assembly of Muslim Youth । ইতোপূর্বে ১৯৬৯ সালে ছাত্র-তরুণদের সংগঠনসমূহের ফেডারেশন International Islamic Federation of Student Organization গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বছরে WAMY -এর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৮২ সালে শিবির IIFSO -এর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৯১ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি লন্ডনে YMO’র সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে কেন্দ্রীয় সভাপতি আ.জ.ম. ওবায়েদুল্লাহ সুদানের রাজধানী খার্তুমে IIFSO-এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনে শিবিরের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের IIFSO-এর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে WAMY-এর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কুয়ালালামপুরে। এ সম্মেলনেও শিবিরের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তুরস্কের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ছাত্রশিবিরের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি যোগদান করে বিশ্ব ছাত্র যুবআন্দোলনকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলন ও ইস্তাম্বুলের বিজয় বার্ষিকী উপলে তুরস্ক গমন করেন। সেখানে তিনি তুরস্কের বিভিন্ন শহরে অনেকগুলি কনফারেন্সে যোগদান করেন। এ সময় তিনি বাহরাইনও সফর করেন। ১৯৯৮ সালে শিবিরের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব মতিউর রহমান আকন্দ জর্ডানে অনুষ্ঠিত WAMY-র আন্তর্জাতিক সম্মেলনে Youth and Contemporary Challenge -এর ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং WAMY-র Asia Pacific অঞ্চলের প্যানেল ডাইরেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৯ সালে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব মতিউর রহমান আকন্দ সুদানের রাজধানী খার্তুমে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ছাত্র যুব সম্মেলনে যোগ দেন। প্রায় ৮০টি দেশের প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে যোগদান করেন। বিদায়ী শতাব্দীর শেষ ও নতুন শতাব্দীর আগমনের প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক প্রোপট এবং ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে ছাত্র ও যুব আন্দোলনের ভূমিকা শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়া মহাদেশে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে সমগ্র বিশ্বের ছাত্র ও যুব সংগঠনসমূহকে একমঞ্চে সমবেত হয়ে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় বিকল্প অভিন্ন প্লাটফর্ম হিসাবে কাজ করার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও আকাশ-সংস্কৃতির মোকাবেলায় মুসলিম বিশ্বের বিত্তশীল দেশের ব্যক্তিদের নিয়ে ফান্ড তৈরি করে ব্রডকাস্টিং নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। সম্মেলনে শিবির সভাপতির এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। শিবির সভাপতির আবেগময়ী বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সুদানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবির সভাপতিকে হযরত মূসা (আ)-এর স্মৃতির প্রতীক লাঠি উপহার দেন। ঐ সম্মেলনে শিবিরের সভাপতি World Parliament -এর সদস্য হিসাবে মনোনীত হন। শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ তাহের WAMY -র এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ডাইরেক্টর ও IIFSO-এর সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে মনোনীত হয়ে দীর্ঘদিন সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ইসলামিক ফোরাম অব ইউরোপ ও YAM -র সম্মেলন উপলে ইংল্যান্ডে যান। তিনি সেখানে ইংল্যান্ড ও ইতালির বিভিন্ন শহরে ইসলামিক ফোরাম অব ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি জমিয়তে তালাবা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সফর করেন। ২০০১ সালে এশিয়া মহাদেশের ছাত্র ও যুবকদের সংগঠন নিয়ে গঠিত হয় Asian Faderation of Muslim Youth. এশিয়া মহাদেশের ছাত্র যুব সংগঠনগুলোকে সমন্বয় করা, সহযোগিতা করা, সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে প্রয়োজনীয় প্রশিণের মাধ্যমে যোগ্য করে গড়ে তোলার লক্ষে AFWY গঠিত হয়েছে। সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত প্রতিষ্ঠাকালীন এ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধিত্ব করেন তৎকালীন বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক। ইসলামী ছাত্রশিবির AFMY-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। AFMY-র উদ্যোগে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত মাসব্যাপী ট্রেনিং প্রোগ্রামে ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধিত্ব করেন কেন্দ্রীয় বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। ২০০১ সালে সংগঠনের তৎকলীন কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম বুলবুল WAMY-র উদ্যোগে World Youth Conference -এ যোগদানের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া গমন করেন। ২০০২ সালে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম বুলবুল WAMY-র উদ্যোগে রিয়াদে অনুষ্ঠিত চতুর্বার্ষিক সম্মেলনে Muslim Youth and Globalization শীর্ষক কনফারেন্সে যোগদান করেন। উক্ত সম্মেলনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি এশিয়ান ফেডারেশন অব মুসলিম ইয়ুথ এর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯ সালে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিগণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এসব কনফারেন্সে শিবির নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ Islamic Scholar Leader দের সাথে মতবিনিময় করেন। ২০০৮ সালে সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ রেজাউল করিম IIUM -এর দাওয়াতে মালয়েশিয়া সফর করেন। সেখানে তিনি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ ছাড়াও আনোয়ার ইব্রাহীমসহ আবিম নেতৃবৃন্দ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত করেন। এ সময় তার সফরসঙ্গী ছিলেন সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শিশির মোহাম্মদ মনির। ২০০৯ সালের প্রথম দিকে সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ রেজাউল করিম IYF (International Youth Forum) -এর আমন্ত্রণে তুরস্ক সফরে যান। সেখানে তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার উপর একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধও উপস্থাপন করেন। একই বছর ১৯ নভেম্বর তিনি হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করেন। সেখানে তিনি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সাথে মত বিনিময় করেন। প্রতি বছর শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সাথে মতবিনিময় করেন। এভাবেই শিবির প্রতিটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দেশের সচেতন তরুণদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসেবে তার ভূমিকা রেখে আসছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির : ঐতিহ্যের কতিপয় দিক বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্রসংগঠন এটি যেখানে অছাত্র অবস্থায় সদস্য থাকা যায় না। অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনে যেখানে অছাত্রদের ভীড় ক্ষেত্রে শিবিরের ঘোষণা একজন শিবির কর্মী প্রথমে ছাত্র তারপর তার অন্যান্য পরিচিতি। ১৯৭৭ সালে পথ চলা শুরু করার পর থেকে প্রতিবছর এই সংগঠনের নেতৃত্বের নির্বাচন হয়ে আসছে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায়, গোপন ব্যালটে এবং কোন প্রার্থীতা ছাড়াই। যার ফলে এ পর্যন্ত কখনও এসব নিয়ে দলীয় কোন্দল জন্ম নিতে পারেনি। বরং নির্বাচিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সভাপতি বা অন্যান্য পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের দায়িত্বের ভয়ে কাঁদতে দেখা যায়। বছর বছর নির্বাচনের ফলে নেতৃত্বের জট কিংবা আদু ভাই নেতৃত্ব গেড়ে বসার কোন সুযোগ এখানে সৃষ্টি হয়নি। ছাত্রশিবিরের এহেন নির্বাচন পদ্ধতি বাংলাদেশের অন্য কোন ছাত্র সংগঠন কল্পনাও করতে পারেনা। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সকল পর্যায়ে চালু আছে ‘মোহাসাবা’ বা গঠনমূলক সমালোচনা। কেবল আল্লাহর ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সংগঠনের কল্যাণ সামনে রেখে যে কোন ব্যক্তি যে কোন দায়িত্বশীল ও কর্মীর আত্মশুদ্ধির নিয়্যতে খোলামেলা আলাপ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সকল সামষ্টিক কর্মসূচির ক্ষেত্রেও এ ধরনের আয়োজন থাকে। ফলে পারস্পরিক দোষারোপ, পরচর্চার পরিবর্তে পরিবেশ ধীরে ধীরে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সুন্দর হয়ে গড়ে উঠে। শিবিরের সকল পর্যায়ের জনশক্তিকে নকল পরিহার করতে হয়। নকল করলে সংশ্লিষ্ট শিা প্রতিষ্ঠান বা শিকগণ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন আর না করুন শিবিরের দায়িত্বশীলগণ জানতে পারলে শপথের কর্মীর (সাথী ও সদস্য) পদ বাতিল হয়ে যায়। কেবলমাত্র খালেছ তাওবা ও নির্দিষ্ট নিয়মের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে এ পদ পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব। শিবির তার কর্মীদের নৈতিক মান রক্ষার ক্ষেত্রে আপসহীন, দায়িত্ববান ও যত্নশীল।ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ার মৌলিক নীতির লংঘন, পর্দার খেলাপ আচরণ, লেনদেন সমস্যা, ওয়াদা খেলাপ ইত্যাদি বিষয়কে শিবির বিশেষভাবে দেখে। এই সুবাদে আজ শিবির কর্মীদের মাঝ থেকে দায়িত্ববান মুসলিম যুবকগণ বের হয়ে আসছেন। শিবির কর্মীদের প্রত্যেককেই নিজের পকেট থেকে নিয়মিত সংগঠনকে এয়ানত বা মাসিক চাঁদা দিতে হয়। অন্য সংগঠনের কর্মীদের যেখানে প্রায় সময় প্রাপ্তিযোগ ঘটে সেক্ষেত্রে শিবির কর্মীদেরকে আর্থিক ও কায়িক কোরবানিতে শরিক হতে হয়। শিবির ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রেও সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রার্থী ঠিক করে থাকে। কোন শিবির নেতা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে কোথাও প্রার্থী হতে পারেন না। সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যে কোন সময় প্রার্থীতা প্রত্যাহার করলেও ব্যক্তির কোন কথা থাকে না। কোথাও শিবিরের প্যানেল জয়ী হলে তারা ছাত্র-ছাত্রী ও প্রতিষ্ঠানের কল্যাণের জন্য জান-প্রাণ দিয়ে পরিশ্রম করেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দলীয় স্বার্থ রা তাদের কর্মসূচির অংশ হয় না, বরং সেবা, পরোপকার ও জাতীয় স্বার্থই হয় তাদের প্রথম ও প্রধান বিবেচনা। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির প্রতি বছর ১৫ আগস্ট ইসলামী শিা দিবস পালন করে, যার প্রধান উদ্দেশ্য নৈতিকতা ও যোগ্যতার সমন্বয়ে কর্মমুখী একটি ইসলামী শিা ব্যবস্থা কায়েম করা যা চাইতে গিয়ে ১৯৬৯ সালে ঘাতকদের হাতে পাশবিকভাবে শাহাদাত বরণ করেন উপমহাদেশের প্রথম ছাত্র শহীদ আব্দুল মালেক। এ দেশে ইসলামী শিার অনুকূলে ইংরেজী শিতিদের ত্যাগ ও কোরবানির ঐতিহ্যমণ্ডিত অধ্যায় শিবিরের একটি সংযোজন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ইসলামের সুমহান আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণেই প্রতি বৎসরই শিবিরের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৃহত্তর ও ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করে থাকে। একইভাবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে যোগ দিয়ে থাকেন। এতে নেতৃবৃন্দের মাঝে মত বিনিময় এবং পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। বিগত ৩২ বছর যেসব নেতৃবৃন্দ শিবিরের সম্মেলনে এসে ছিলেন তাদের অনেকেই আজ সেই সব দেশের সম্মানিত মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও জাতীয় ব্যক্তিত্ব। হত্যা, সন্ত্রাস ও নির্যাতন মোকাবেলায় শিবিরের ঐতিহ্য ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ও রহমানের প্রকৃত বান্দা হিসেবে পৃথিবীর আগামী দিনের নেতা হিসেবে ছাত্রসমাজকে প্রস্তুত করার লক্ষে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা, সফল সেনানায়ক ও সার্থক রাষ্ট্রপতি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আদর্শকেই গ্রহণ করেছে। ফলে এ সংগঠন বিগত ৩৫টি বছর ধরে তাঁর রেখে যাওয়া পথ অনুসরণ করে যাচ্ছে। এটি শিবিরের একটি বড় ধরনের অর্জন। রাসূল (সা.) যেমন নবুয়তের ঘোষণা আসার সাথে সাথে কায়েমী স্বার্থবাদীদের রক্তচুর মুখে পড়লেন, তেমনি শিবির তার যাত্রা শুরু করার সাথে সাথে ইসলাম বিরোধী মহল, কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীরা তাদের শত্রুতা শুরু করেছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধাচরণ, শিবির নেতাকর্মীদের ব্যাপারে অপপ্রচার ছড়ানো, শিবিরের কর্মসূচির উপর হামলা, শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, শিবির কর্মীদেরকে ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে আঘাতে জর্জরিত করা, গোপনে ও প্রকাশ্যে হামলা করে শিবির কর্মীদের হত্যা করা এসবই হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি গোষ্ঠীর একমাত্র কাজ। শিবির এসব অপপ্রচার, হামলা, সন্ত্রাস ও নির্যাতনের মোকাবেলায় 'TAD' পলিসি বজায় রেখে চলছে। শিবিরের দায়িত্বশীল ও কর্মীগণ সব সময়েই সহনশীলতা , এড়িয়ে যাওয়াএবং উপায়ন্তর না পেলে আত্মরামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আত্মরার এ অধিকার তো একটি বনের প্রাণীরও রয়েছে। ‘চোরের মার বড় গলা’র মতো অনেকেই বরাবরই শিবিরেকে দোষ দিয়ে আসছে এবং শিবিরকে উল্টো সন্ত্রাসী, হত্যাকারী ও অসহিষ্ণু প্রমাণ করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সংগঠনের হামলায় শিবিরের ১৩৯ জন তাজা তরুণ কর্মী শাহাদাত বরণ করেছে। ওরা জানে না কী তাদের অপরাধ, কেন ওদের হত্যা করা হয়েছে। তেমনিভাবে আহত, পঙ্গু হয়ে কষ্টকর জীবন যাপন করছে শিবিরের শত শত কর্মী। চোখ, হাত, পা হারানো এসব ভাইদের সকরুণ জিজ্ঞাসা- “কেন আমাদের এমন হলো”? কেউই তার উত্তর দেয় না, অথচ সবাই এর উত্তর জানে। “তাদের একমাত্র অপরাধ (!) তারা মহাপরাক্রমশালী সপ্রশংসিত আল্লাহর উপর ঈমান পোষণ করেছে”। ওরা জীবন দিয়ে শাহাদাতে হক্বের স্ব্যা রেখেছে। ওরা পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কিন্তু বাতিলের সাথে আপস করেনি। ওরা লড়তে লড়তে জীবনের দাম খুঁজে পেয়েছে। আর এভাবে মৃত্যুর মাঝে জীবনের সন্ধান করে ফেরাই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের এক অনন্য ঐতিহ্য। “আমাদের প্রত্যয় একটাই, আল্লাহর পথে মোরা চলবো নিকষ কালিমা ভরা আকাশে ধ্রুব জ্যোতি তারা হয়ে জ্বলবো” বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির-একটি নাম, একটি ইতিহাস, আল্লাহর পথের এক দুঃসাহসী কাফেলা। হাঁটি হাঁটি পা পা করতে করতে পিছনে ফেলে এলো পঁয়ত্রিশটি সোনালী বছর। শিবির পরিণত হলো তৌহিদি ছাত্র-জনতার আস্থা, ভালোবাসা, স্বস্তি ও মুক্তির এক প্রিয় ঠিকানায়। মায়ের মায়াবী আঁচল, বাবার স্নেহের বাঁধন, বোনের আদরের ডাক, ছোট্ট সোনামণিদের করুণ চাহনি কিছুই পিছনে টেনে রাখতে পারে না একজন শিবির কর্মীর সামনে বাড়ানো পা দুটিকে। ত্যাগ কোরবানির এক প্রচণ্ড আগ্রহ, জান্নাতের এক দুর্বার আকর্ষণ তার ছিন্ন মস্তককেও অবিচল চেয়ে থাকতে সাহস জোগায় সামনের পানে। শিবির তাই আজ এক বিপ্লবী কাফেলা এবং এক অকুতোভয় তারুণ্যের নাম। সুদৃঢ় ও প্রত্যয়দীপ্ত এ কাফেলা একজন ছাত্রের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সাজাতে চায় স্বপ্ন, সংগ্রাম আর অর্জনের এক বিশাল সৌধের মতো করে। ঐতিহ্য সংরণ, ইতিহাস সৃষ্টি আর গৌরবময় ভবিষ্যৎ রচনার বিরামহীন প্রয়াসই শিবিরের পাথেয়। আজ যে “বাংলার ঘরে ঘরে, দুঃখীদের কুঁড়ে ঘরে” নতুন আশার বাণ ডেকেছে “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির” এই জোয়ারের সূতিকাগার। দুর্বার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পঙ্কে নিমজ্জিত বাংলাদেশের তরুণদের মুখে কালেমার বিপ্লবী বাণী তুলে দিয়েছে শিবির, তাদের বল্গাহীন জীবনে দিয়েছে বিবেক ও সুন্দরের লাগাম, তাদের মাঝে সৃষ্টি করেছে ধ্রুব জ্যোতি তারার স্বচ্ছতা ও জ্যোতির্ময় চরিত্রের সমাহার। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসুলের (সা.) শাফায়াত অর্জনের পথে শিবির ছুটে চলছে তিন দশকের এক প্রত্যয়ী অশ্বারোহীর মতো। তার কণ্ঠে তাই বিদ্রোহী কবি, ইসলামের কবি নজরুলের সেই বিপ্লবী গান- “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে! লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।”
Posted on: Fri, 06 Sep 2013 05:22:18 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015