দেশনেত্রী বেগম খালেদা - TopicsExpress



          

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ভাইয়ের বিশ্লষনে বর্তমান সরকার। এখানে আওয়ামী লীগের অনেক অসুখের কথা তুলে ধরেছেন। সবাই পড়তে অনুরোধ। শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ----------জনতার কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ----------- অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রাখতে চায় যে কোনো পন্থায়। তাদের ধারণা রাজপথ দখলে রেখে নির্বাচনে কারচুপি করলে তা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ হবে না। আওয়ামী লীগ পেশিশক্তির বলে নির্বাচনী জয় ও ক্ষমতায় থাকা নিরাপদ মনে করে। এটি আওয়ামী লীগের অতি সনাতন স্ট্র্যাটেজি। রাজপথ দখলে রাখতে আওয়ামী লীগ সব সময় দলীয় গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে অন্যদলের সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভণ্ডুল করে। মুজিব আমলে ১৯৭৩ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, সে নির্বাচনেও বিরোধী দলগুলোকে রাজপথে নামতে দেয়া হয়নি, এমনকি নমিনেশন পেপারও জমা দিতে দেয়া হয়নি। বিরোধী দলের প্রার্থীদের ঘরে বন্দি রেখে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিত ায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জয়ের জন্য রাজপথের দখলদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকলে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজপথ দখলে নেয়া সম্ভব হয় না। ফলে আওয়ামী লীগের বিপদ বাড়ে। এজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিদায় করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ বলছে, জনগণের ভোটের অধিকার পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। সাপের খোলস পাল্টানোর মতো যুগে যুগে আওয়ামী লীগ খোলস পাল্টায়। আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বরখেলাপ করলেও প্রভুর স্বার্থরক্ষায় থাকে সদা নিবেদিত। ২০০৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল পাঁচটি বিষয়—১. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা। ৩. বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সঙ্কট মোকাবিলা। ৪. দারিদ্র্যবিমোচন ও বৈষম্য দূর করা। ৫. সুশাসন প্রতিষ্ঠা। ‘নির্বাচনী ইশতেহারে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’তে লিখেছিলেন—১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ। ২. রাজনৈতিক কাঠামো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও গণঅংশায়ন। ৩. সুশাসনের জন্য আইনের শাসন ও দলীয়করণ প্রতিরোধ। ৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। ৫. দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন। ৬. নারীর ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা। একটু লক্ষ করলে দেখা যায় প্রতিশ্রুতির সবগুলোতে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেখা যাক অতীতের কিছু ঘটনা ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো সামরিক সরকারের জারি করা আইনগত কাঠামো আদেশ (এলএফও) মেনে নেয় এবং বিজয়ী হলে এলএফওর আওতায় শাসনতন্ত্র রচনায় অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে। ১৯৭০ সালে অখণ্ড পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের আগে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি স্মরণকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু, রাজবন্দিদের মুক্তি না দেয়া এবং এলএফওর অন্যায় ধারার প্রতিবাদে নির্বাচন বর্জন করে। এর ফলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু নির্বাচনের পর শেখ মুজিব ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার কথা বললে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। আর এই বিরোধের জের ধরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ, ১৯৭১ বেলা ১টায় বেতারে পাঁচ মিনিটের এক ভাষণে ৩ মার্চ, ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অধিবেশন আকস্মিকভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ দেশের মানুষ উদ্বেলিত হয় তার ভাষণে। এই ভাষণে তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতি এই বলে দাবি জানান যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এরপর শেখ মুজিব ক্ষমতা হস্তান্তর করার বিষয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে মিলিত হন, যা ২৪ মার্চ পর্যন্ত চলে। মূলত তিনি ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতার দেন-দরবার করে চলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। ২৪ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত যতবার আলোচনা করে বের হয়েছেন, ততবারই সাংবাদিকদের শেখ মুজিব বলেছেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সকাল পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ মুজিব-ইয়াহিয়ার আলোচনার ফলাফলের অপেক্ষায়। ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে পূর্ব বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা দিলেন এবং আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ভারতে নিরাপদ আশ্রয় বা আত্মগোপনে চলে গেলেন। নিরস্ত্র জনগণকে লক্ষ করে ছুটে গেল ট্যাংক, কামান আর মেশিনগানের গোলা। গোলাগুলির গগনবিদারী আওয়াজে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। শুরু হলো নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুুণ্ঠন—যা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। আমরা আরও জানতে পারি, ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় জনাব তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের বাসায় গিয়ে তাকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখে দেয়ার প্রস্তাব জানালে শেখ মুজিব তাতে রাজি না হলে তাজউদ্দিন সাহেব হতাশাগ্রস্ত হয়ে শেখ মুজিবের বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। তাজউদ্দিন সাহেবের প্রস্তাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘না, আমি পাকিস্তান সরকারের চোখে দেশদ্রোহী হিসেবে পরিগণিত হতে চাই না (পূর্বাপর, মইদুল হক)।’ একই রাতে শেখ মুজিব ঢাকার ধানমন্ডি বাসভবন থেকে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করলে জাতিকে সেই মুহূর্তে দিকনির্দেশনা দেয়ার মতো কেউ ছিল না। সেদিন দিশেহারা জাতিকে দিক দেয়ার উদ্দেশ্যে এমনকি নিজের পরিবারের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মেজর জিয়া এগিয়ে আসেন। সেই রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়া পাকিস্তান বাহিনীর এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে তাত্ক্ষণিকভাবে বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন এবং তার ইউনিটের অধিনায়কসহ কয়েকজন পাঞ্জাবি অফিসারকে বন্দি করে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বিদ্রোহ সংগঠিত করেন। এরপর তার অধীনস্থ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকদের নিয়ে অস্ত্র-গোলাবারু দসহ সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসেন। জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেদিনের সেই দুঃসময়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ধ্বনিত হয় মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা। জাতি পায় দিকনির্দেশনা। রুখে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। শুরু হয় গৌরবদীপ্ত স্বাধীনতার যুদ্ধ। তালুকদার মনিরুজ্জামানের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, রাষ্ট্রপতি জিয়া ভারত সফরে গেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রপতি জিয়ার সম্মানে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে তার উদ্দেশে ভাষণে বলেন : ‘You have written your name in the history by declaring independence of Bangladesh.’ দীর্ঘ নয় মাস নিরীহ-নিরপরাধ লাখ লাখ মানুষকে নৃশংসভাবে ও নির্বিচারে খুন, নির্যাতন ও ধর্ষণ করে পাক হানাদার বাহিনী। অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অমিত বিক্রম লড়াই আর অপরিসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে পাক হানাদার বাহিনী অবশেষে চরমভাবে পরাজিত ও বন্দি হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় হলো, পাক হানাদার মুক্ত হলো। পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীন একটি দেশ, স্বাধীন একটি ভূখণ্ড, আর লাল-সবুজের একটি পতাকা পেল। এটা মনে রাখা জরুরি, আওয়ামী লীগ একা দেশ স্বাধীন করেনি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে এবং আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্ব ছিল ভারতে। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। ছাত্র-জনতা বাঙালি সৈনিক সে ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বলেছেন, তার জ্যেষ্ঠ ছেলে রুমি ইমাম শেখ মুজিবের ডাকে আত্মত্যাগ করেনি। সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মেজর জিয়ার ডাকে। বাংলাদেশের মানুষের একটাই ভাবনা ছিল তখন—কী করে তারা শত্রুকে বিতাড়িত করবে, দেশ স্বাধীন করবে। সেটাই ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে তারা স্বাধীনতাকেই বুঝিয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নয়। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসামান্য ত্যাগ স্বীকারকারী ব্যক্তি, রাজনীতিক, প্রতিষ্ঠান ও দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠনের দাবিকে অগ্রাহ্য করে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হয় এককভাবে আওয়ামী লীগ। তারপরই শুরু হলো বাংলাদেশের মানুষের ওপর অপ্রত্যাশিত এক তাণ্ডব। শুরু হয় লুটপাট, হত্যা, গুম, খুন, মজুতদারি, চোরাকারবারি, হাইজ্যাক ও খোলা সীমান্ত দিয়ে দেশের সম্পদ পাচার এবং বিদেশি নিম্নমানের পণ্য দিয়ে বাংলাদেশের বাজার দখলের খেলা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিব। ১১ জানুয়ারি প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় আদেশ জারি শেষে ১২ তারিখ থেকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে করেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের যাত্রার প্রায় শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের আশাভঙ্গ শুরু হয়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এবং দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করতে থাকে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ মুজিব স্বৈরাচারী নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি হাল ধরতে পারেননি। সব ব্যর্থতার সঙ্গে এসে যোগ হয় চরম দুর্নীতি। সেই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্তার হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজ পরিবার-পরিজনদের নেতৃত্বে। শাসকদল আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে জনগণ আশাহত হতে থাকে। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এমন এক পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বছরখানেকের মধ্যেই অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। তার স্থলে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি সরকারপ্রধানের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির আদেশবলে [প্রেসিডেন্সিয়া ল অর্ডার (পিও)] নতুন নতুন আইন জারি করতে কোনো দ্বিধা বা সংকোচ করেননি। বছর দুয়েকের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। এ অবস্থা থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করার পরিবর্তে শেখ মুজিবুর রহমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী ও একনায়কতন্ত্রসুল ভ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অনাহার-অত্যাচার ে নিপীড়িত দেশবাসী হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ। কেন এমন হলো তার উত্তর পাওয়া যাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলীর বিবরণ থেকে। দিকে দিকে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য কী চেয়েছিল পূর্ব বাংলার জনগণ, ২৩ বছর ধরে জনগণকে কী শোনানো হয়েছিল? সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ চেয়েছিল—অবাধ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দেশের সার্বিক অগ্রগতি অর্জন করা, শোষণ ও নিষ্পেষণের শিকার না হয়ে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করা। কিন্তু অবস্থা দাঁড়াল ঠিক তার বিপরীত—আওয়ামী লীগ সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন করার জন্য বিভিন্ন বাহিনী সৃষ্টি করে। আর এ বাহিনী সরকারবিরোধী মুক্তিযোদ্ধা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামস নামধারী সশস্ত্র বেসামরিক বাহিনী বাংলাদেশের জনসাধারণের ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের মদতপুষ্ট বিভিন্ন বেসরকারি সশস্ত্র বাহিনী অনুরূপ এক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা ছিল তথাকথিত ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ এবং তার সঙ্গে ছিল আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, লালবাহিনী, নীলবাহিনী, মুজিববাহিনী ইত্যাদি। এসব বাহিনী ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার সরকারবিরোধী স্বাধীনচেতা তরুণ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে হত্যা করে। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এক সরকারি পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ মাসে এ দেশে ৪ হাজার ৯২৫ ব্যক্তি গুপ্তহত্যার শিকার হয়, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে ২ হাজার ৩৫টি, নারী অপহরণ হয় ৩৩৭টি এবং ধর্ষিত হয় ১৯০ মহিলা। থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট হয় ৬০টি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি কোষাগারে ঘটে সশস্ত্র ডাকাতি ও লুণ্ঠন। স্বাধীনতা-পরবর্ তী ১৯৭২ সালে একদিকে বন্যা, অন্যদিকে ব্যাপক চোরাচালান ও লুটপাটের ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চরম মূল্যবৃদ্ধি পায়। বাড়িভাড়া, পরিধানের বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, মজুতদারি ও সমাজবিরোধীদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। দুর্নীতি ও সরকারি নিপীড়নের ব্যাপকতায় ১৯৭৪ সাল নাগাদ দেশে এক গুরুতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা বলতে কোনো কিছুই ছিল না, ছিল চরম নৈরাজ্য। সরকারি ও বেসরকারি বাহিনী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চালায় ডাকাতি, রাহাজানি, হাইজ্যাক, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি। ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চালায় অবাধ লুটপাট। সরকার ও তার প্রশাসনযন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একেবারেই প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বরকন্দাজ বাহিনীতে পরিণত হয়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ জনগণকে বিশ্বাস করে না, তাই তারা নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও ব্যাপক কারচুপি করে। এমনকি সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী প্রকাশ্যে ভোট কারচুপিতে অংশগ্রহণ করে। ভোটগণনা শেষে ফলাফল ঘোষণাকালেও শাসকদলের পক্ষে চরম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চট্টগ্রাম থেকে একটি আসনে মোজাফ্ফর ন্যাপের একজন প্রার্থী রাতে নির্বাচনে জয়ী ঘোষিত হলেও পরদিন সকালে তাকে পরাজিত বলে ঘোষণা করা হয়। জাসদ সভাপতি মেজর জলিল, ন্যাপের রাশেদ খান মেনন, ড. আলীম আল রাজী, অলি আহাদসহ আটজনের বিজয় নাকচ করে দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও অপশাসন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনকাল ছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, শোষণ-নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, হাইজ্যাক, কিডন্যাপ, চোরাচালান, দুর্নীতির মহাকাল। বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না, ছিল না মানবাধিকার ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের অধিকার। জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে আদালতে বিচার প্রার্থী হতে হতো। অধিকাংশ মানুষেরই ক্ষমতা ছিল না বিচার প্রার্থী হওয়ার। রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের হাজার হাজার ঘটনা ঘটে, যা আওয়ামী লীগের শাসন আমলের এক কলঙ্কিত ইতিহাস হিসেবেই পরিচিত। ১৯৭২ সালের যে কোনো জাতীয় সংবাদপত্র খুললে প্রথমেই চোখে পড়বে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর। প্রতিদিনই শহরে ও গ্রামাঞ্চলে চলছিল ত্রাসের রাজত্ব। এ ত্রাসের নাগপাশে জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দিন অতিবাহিত করছিল। যখন মানুষের পেটে ভাত নেই, তখন লাখ লাখ টন বিদেশি সাহায্যে প্রাপ্ত খাদ্য নির্বিবাদে পাচার হয়ে গিয়েছিল সীমান্তের ওপারে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী চোরাচালানের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তিনি আওয়াজ তোলেন ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। জবাবে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চীন ও পাকিস্তানের দালাল এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক প্রভৃতি বলে আখ্যায়িত করে। অথচ ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যাবে, ১৯৬৮-৬৯-এর সাড়াজাগানো গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগরতলা মামলা থেকে শেখ মুজিবকে মুক্ত করেন মওলানা ভাসানী। মওলানার সর্বজনীন আহ্বানের প্রেক্ষিতেই আসে ১১ দফা আন্দোলন। কিন্তু তার মতো একজন অভিজ্ঞ, প্রবীণ ও উদারপন্থী রাজনৈতিক নেতাকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা বলে গালাগাল দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি আওয়ামী লীগ। সে সময় একমুঠো খাবারের জন্য চারদিকে হাহাকার। রিলিফ ক্যাম্প ও লঙ্গরখানা স্থাপন করা হলেও তাতে খাবার মিলত না। চালের পয়সা জোগাড় করতে অনেক বাবা-মা কোলের সন্তানটিকেও বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের জন্য এককভাবে দায়ী আওয়ামী লীগের দুঃশাসন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে প্রায় ৬ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কারণগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—১. দুর্নীতি, ২. স্বজনপ্রীতি, ৩. চোরাচালান, ৪. বর্ডার ট্রেড, ৫. রিলিফ আত্মসাত্ ইত্যাদি। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম সেসব কলঙ্কিত ইতিহাসের দিনগুলোর কথা জানে কি? বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সেগুলো জানার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৯৩ হাজার পাক হানাদার সৈন্য আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে ১৯৫ জনকে গুরুতর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাক বাহিনীর সহযোগী হিসেবে ৩৭ হাজার এদেশীয় নাগরিককে গ্রেফতার করা হয় এবং দালাল আইনে বিচার শুরু হয়। বিচার চলার মাঝামাঝি অবস্থায়ই ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ উপমহাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের লক্ষ্যে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে নয়াদিল্লিতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্র ী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্র ী শরণ সিং এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ। ওই চুক্তির ১৩, ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদ নিম্নে দেয়া হলো: : ১৩. উপমহাদেশে শান্তি এবং বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপনে (reconciliation ) সরকারসমূহের ঐকান্তিক ইচ্ছার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীত্রয় ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিষয়টি (Question) নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্র ী বলেন যে, এ সকল যুদ্ধবন্দী যেসব বাড়াবাড়ি (Excesses) করেছে এবং বহুমাত্রিক (manifold) অপরাধ সংঘঠিত করেছে, UN General Assembly Resolutions এবং গণহত্যা (মবহড়পরফব) এবং বিশ্ববাসী এই বিষয়ে একমত (Consensus) যে, এই ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের মতো ব্যক্তি, যারা এ ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত, তাদেরকে যথাযথ আইনানুগ পন্থায় জবাবদিহি করতে ও যথাযথ আইনের আওতায় আনা উচিত (Should be held to account and subjected to the due process of law)। পাকিস্তান সরকার-এর প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন যে, কোন অপরাধ সংঘঠিত হয়ে থাকলে, তার সরকার সেটির নিন্দা এবং গভীর অনুতাপ জানায় (his Govt. condemned and deeply regretted any crime that may have been committed)। ১৪. এ প্রসঙ্গে মন্ত্রীত্রয় বলেন যে, বিষয়টিকে শান্তি পুনঃস্থাপনে তিন সরকারের দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার যে দৃঢ় ইচ্ছা (determination) সে প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। মন্ত্রীত্রয় আরও উল্লেখ করেন যে, স্বীকৃতি প্রদানের পরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ পেলে তিনি বাংলাদেশ সফর করবেন এবং শান্তি পুনঃস্থাপন প্রক্রিয়া Promote করার স্বার্থে অতীতের ভ্রান্তিসমূহ ক্ষমা করতে এবং ভুলে যেতে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ধঢ়ঢ়বধষ জানাবেন (Appeal to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistake of the past)। একইভাবে ১৯৭১ সনে বাংলাদেশে যে নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসযজ্ঞ (Atrocities and destruction) সংঘটিত হয়েছে, সে বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ জানে কীভাবে ক্ষমা করতে হয় এবং তিনি চান দেশবাসী অতীত ভুলে যাক এবং নতুন করে আরম্ভ করুক (Similarly, the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971 that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive). ১৫. উপরে উল্লেখিত বিষয়াবলীর আলোকে এবং বিশেষ করে অতীতের সকল ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়ে তা ভুলে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আপিলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্র ী জানান যে, দয়াপরবশ হয়ে (as an act of clemency) বাংলাদেশ সরকার বিচার কার্য পরিচালনা (Trials) নিয়ে আর অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দিল্লী চুক্তির আওতায় বর্তমানে প্রত্যাগমন প্রক্রিয়াধীন অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে প্রত্যাগমন করা যেতে পারে মর্মে একমত পোষণ করা হয় (it was agreed)। ওই চুক্তির বলেই বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি প্রদান করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, ২ জুলাই, ১৯৭২ পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার নমনীয়তা প্রদর্শন শুরু করে। পরে শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত ছাড়া ২৬ হাজার ব্যক্তি (যারা রাজাকার-আলবদর-আ ল শামস, পিস কমিটির সদস্য) সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তি পান। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা নতুন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অভিনব প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ২৫ মার্চ, ২০০৯ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হয় যে, সরকার ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধীদের ১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় বিচার করবে। আইনমন্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৬ মে, ১৯৭৩ এবং ৩০ নভেম্বর, ১৯৭৩ অপরাধ মার্জনাসংক্রান্ ত ঘোষণা প্রদান করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে : Bangladesh government announced amnesty first on 16th may 1973 under the 1972 Collaborator (Special Tribunals) Order for person convicted or charged with offences under this Law. A second amnesty was announced under the same law on November 30, 1973 for those who were convicted on accused of serious crimes. এখানে উল্লেখ্য, বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইনটি বাতিল করেন। দালাল আইন বাতিলসংক্রান্ত অধ্যাদেশের ২(২) অনুচ্ছেদ বলা হয়: Upon the repeal of the said order under sub-section(1), all trials or other proceedings there under pending immediately before such repeal before any Tribunal, Magistrate or Court, and all investigations or other proceedings by or before any Police officer or other authority under that Order, shall abate and shall not be proceeded with. এর ফলে দণ্ডিত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্যরা পর্যায়ক্রমে খালাস পায়। আওয়ামী লীগ নেতারা সব জানা সত্ত্বেও সুচতুরভাবে দেশবাসীকে সত্য জানতে দিতে চায় না। সরকার পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও ভয়াবহ দুর্নীতির কারণে মুজিব আমলের শেষ সময়ে ভারত ছাড়া আন্তর্জাতিক দুনিয়ার প্রায় সব দেশ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। স্বাধীনতা-পরবর্ তী যুদ্ধাপরাধ ও স্বাধীনতাবিরোধী দের বিচার ইস্যু, তার ওপর আওয়ামী লীগের কয়েক বছরের অপশাসনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সরকারের ভ্রান্তনীতি ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। দুর্নীতির কারণে দেশের শিল্প ও কৃষি উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে পড়ে অচল। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হয় দ্রুত নিম্নগামী। ক্ষুধার্ত দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য বিভিন্ন দেশ ও অন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত বিপুল ত্রাণসামগ্রী বাংলাদেশের ভেতরে ও সীমান্তের ওপারে আবাধ লুণ্ঠনের বস্তুতে পরিণত হয়। দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। অতীতের দুর্ভিক্ষের মতো চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষও খাদ্যশস্যের অভাবের জন্য হয়নি। দুর্ভিক্ষের সময় দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত ছিল বলে এক পরিসংখ্যানে জানা যায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনাহারে লাখ লাখ লোক মারা যায়। নোবেলবিজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ [Poverty and Famines : An essay on Entitlement and Deprivation (Oxford : Clarendon press, 1981)] গ্রন্থে লিখেছেন : বাংলাদেশে তখন যথেষ্ট খাদ্য মজুত ছিল, কিন্তু প্রশাসনিক ত্রুটি ও বণ্টনের সুব্যবস্থার অভাবে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ হয়। ১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের তত্কালীন খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার জানান, দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ৫০০। বেসরকারি সূত্রমতে, এই সংখ্যা ছয় লাখ। সরকার সে সময় ৫ হাজার ৮৬২টি নঙ্গরখানা খোলে। সে সময় নারীর লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্রের অভাবে বাসন্তী-দুর্গতি দের মাছ ধরার জাল পরার চিত্র বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করে। কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা মুড়ে লাশ দাফন ছিল তখনকার নিত্যনৈমিত্তিক দৃশ্য। একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ওপর চতুর্থ সংবিধান সংশোধনী বিল চাপিয়ে দেন। সে সংশোধনী কোনো আলোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যে পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। সেই বিলে শেখ মুজিবকে আজীবন রাষ্ট্রপতি করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ ওই সংশোধনীতে স্বাক্ষরদান করলে তা দেশের সংবিধানে সংযোজিত হয়। এখানে আইনের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। সংশোধনীটি আইনগতভাবে ছিল অবৈধ এবং রাজনৈতিকভাবে ছিল দেশে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শামিল। পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংশোধনী বিলটি ফাস্ট রিডিং বা প্রথম পাঠে সংসদে উত্থাপন, দ্বিতীয় পাঠে আলোচনা এবং তৃতীয় পাঠে ভোটগ্রহণের আইনি প্রক্রিয়া আগ্রাহ্য করে শুধু সংসদ সদস্যদের টেবিলে দিয়ে পাঠ বা আলোচনা ছাড়াই সরাসরি কণ্ঠভোটে পাস করানোর ফলে সংশোধনীটি হয়ে পড়ে অবৈধ। কিন্তু স্পিকার মালেক উকিল আইন, বিধি সব ভুলে বিলের পক্ষে কাজ করে যান। সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ নজির স্থাপন হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে, এভাবেই একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব হলেন বাকশালের চেয়ারম্যান। গণতন্ত্র হত্যা করে বাকশালের চেয়ারম্যান হিসেবে দেশ পরিচালনা করাই ছিল শেখ মুজিবের বড় ট্র্যাজেডি। এই শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবকে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে। ২০১৩ সালে ক্ষমতার শেষ বেলায় এসে বাকশালের নব প্রজন্মওয়ালারা আবার আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী পথে ধাবিত করতে তত্পর হয়েছে। সেনাবাহিনীকে দুর্বল ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম কাতারের সৈনিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ বাহিনীই পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে ওঠে। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ও ডাকে সাড়া দিয়ে প্রথমেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়ে। রণাঙ্গনের সবক’টি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সেনা অফিসাররা। সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশে সবচেয়ে অবহেলার শিকার হয় সামরিক বাহিনী। আওয়ামী লীগ মনেপ্রাণে শক্তিশালী সেনাবাহিনী চায়নি। তাই স্বাধীনতার পরপরই তারা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও ভারতফেরত মুজিব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠন করে জাতীয় রক্ষীবাহিনী। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয় রক্ষীবাহিনীকে। প্রতিরক্ষা বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত রক্ষীবাহিনীর জন্য। পক্ষান্তরে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের জন্য বরাদ্দ ছিল কাঁকরভর্তি গন্ধযুক্ত চাল ও অন্যান্য নিম্নমানের দ্রব্যাদি। তাদের ছিল না বুট জুতা, ছিল না মোজা। ছেঁড়া বুট, ছেঁড়া মোজাই তাদের পরিধান করতে হতো। ফলে সেনাবাহিনীতে বিরাজ করছিল একরাশ হতাশা ও অসন্তোষ। বিরোধী রাজনৈতিক দল দলন স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপর গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। এই দলটি গঠনের পর আওয়ামী বাকশালী সরকার জাসদের হাজার হাজার নেতা ও কর্মীকে হত্যা, নির্যাতন ও কারাগারে নিক্ষেপ করে। রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার-নির্যা তনে সারা দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়। হাজার হাজার বামপন্থী নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশার জনগণের ওপর নেমে আসে আওয়ামী বাকশালী সরকার, তাদের অঙ্গসংগঠন ও রক্ষীবাহিনীর নির্মম নির্যাতন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে সেসময়ে গৃহবন্দি করা হয়, চলাচলে বাধাগ্রস্ত করা হয়। সে সময় রাজনীতিবিদদের মধ্যে মশিউর রহমান যাদু মিঞা, মেজর (অব.) জলিল, আসম রব, আবদুল মতিন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা আহ্বায়ক), কমরেড টিপু বিশ্বাস, আলাউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক লুত্ফর রহমান, সিরাজুল হোসেন খান, শরদিন্দু দস্তিদার, অধ্যাপক ইয়াকুব আলী, অনিল লালা, বিমল বিশ্বাস, সাংবাদিকদের মধ্যে এনায়েতুল্লাহ খান, আতিকুল আলম, ফজলে লোহানী, বোরহানউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ ইরফানুল বারী, অধ্যাপক ফয়জুর রহমান, নারী নেত্রীদের মধ্যে ফেরদৌস আরা, সালমা মুকুল, রূপা দত্ত, অরুণা সেনসহ আরও অনেককে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয় দীর্ঘদিন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতারের পর সাভারের নির্জন স্থানে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী বাকশালী সরকারের রক্ষীবাহিনী ও স্পেশাল ফোর্স। তাকে হত্যার পর শেখ মুজিবুর রহমান পবিত্র সংসদে গর্বভরে ঘোষণা করেন, আজ কোথায় সিরাজ সিকদার? খুব আশ্চর্য ব্যাপার, স্বাধীনতা-পরবর্ তী সময়কালে সাধারণ মানুষ সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের একটি লক্ষ্যও পূরণ করতে পারেনি, বরং উল্টো জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয় শোষণ, নির্যাতন আর উত্পীড়ন। আওয়ামী লীগের সেই সাড়ে তিন বছরের শাসন ছিল হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসের অজস্র ঘটনায় ভরপুর। স্বাধীনতা-পরবর্ তী ’৭২-৭৫ সময়কালে রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, জামায়াতে ইসলামী দলের প্রায় সবাই আত্মগোপনে ও নিরাপদে থাকতে পারলেও একই সময় ৪০ হাজার বামপন্থী, প্রগতিশীল তরুণ রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে খুঁজে নির্বিচারে খুন করা হয়। বাকশাল গঠনের আগে মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক হক কথা, দৈনিক গণকণ্ঠ, সাপ্তাহিক মুখপত্র, দ্য স্পোকসম্যান ও অন্যান্য কয়েকটি পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। বাকশাল গঠনের পর একদল, এক নেতা ও চারটি সরকারি সংবাদপত্র রাখা হয়। এই চারটি সংবাদপত্র সরকারের মুখপত্র হিসেবে কাজ করতে থাকে। আর সব রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়। মৌলিক অধিকার, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনত া, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে দেশে ছিটেফোঁটাও ছিল না। জনগণের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। মহিলাদের সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়া মোটেই নিরাপদ ছিল না। দেশে শিক্ষিত ও সাধারণ শ্রমজীবী বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাজাহারুল হক সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, আমাদের অর্থনীতি যুদ্ধবিধ্বস্ত বললেও ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সব কলকারখানা অটুট ছিল। কলকারখানা থেকে যেসব যন্ত্রপাতি উঠিয়ে নেয়া।
Posted on: Tue, 03 Sep 2013 05:43:19 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015