নজরুল কি সর্বযুগের - TopicsExpress



          

নজরুল কি সর্বযুগের কবি? মীজান রহমান বাংলাদেশে আজকাল রবিঠাকুর আর কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিন একসাথে পালন করবার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়ে গেছে। ফলে রবীন্দ্র-নজরুল শব্দদুটি যেন যুগলবন্দী হয়ে পরস্পরের সাথে মিশে গেছে। ঠিক যমজ না হলেও সহোদর তো বটেই। এটা অবশ্য সত্য যে দুজনেরই জন্ম একই মাসে—তবে ৩৮ বছরের ব্যবধানে। মজার ব্যাপার যে তাঁদের মৃত্যুও ঠিক একই মাসে—তা’ও ৩৫ বছরের ব্যবধানে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের ভুললে চলবে না যে পৃথিবীর কোথাও বোধ হয় এমন নজির নেই যেখানে দুজন বড় কবির জয়ন্তী একই দিনে পালন করা হয়েছে। আমাদের দেশেও হত কিনা সন্দেহ যদি না এদুটি নামের সাথে দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছাপ থাকত। এতে করে দুজন অসাধারণ ব্যক্তিকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে সমান উচ্চতাবিশিষ্ট মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রয়াস প্রায় অপ্রচ্ছন্নভাবেই প্রতীয়মান, অন্তত আমার চোখে। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ইসলামের বন্ধনীবদ্ধ জয়ন্তী পালনের পক্ষপাতী আর যে’ই হোন, আমি নই। এতে দুজনেরই প্রকৃত পরিমাপ পরিবর্ধিত হওয়ার পরিবর্তে খানিক সঙ্কুচিত হয় বলেই আমি মনে করি। তাঁরা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এই ‘রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী’ নিয়ে কি ধারণা পোষণ করতেন কল্পনা করতে লোভ হয়। রবীন্দ্রনাথ হয়ত একটু মুচকি হাসতেন কেবল–একটু কৌতুক, একটু উদার সহিষ্ণুতা্র হাসি। আর নজরুল? হয়ত লজ্জায় লাল হয়ে যেতেন। হয়ত জিভ কেটে বলতেনঃ সব্বনাশ, তোমরা আমাকে গুরুদেবের পাশে দাঁড় করিয়েছ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের সংবাদ শুনে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এবং অতি অল্প সময়ের ভেতর তিনটে কবিতা লিখে ফেলেছিলেন। তাঁর ভাষাতেঃ “ তোমার গরবে গরব করেছি, ধরারে ভেবেছি সরা, ভুলিয়া গিয়াছি ক্লৈব্যহীনতা উপবাস ক্ষুধা জরা। মাথার উপরে নিত্য জ্বলিতে তুমি সূর্যের মত, তোমার গরবে ভাবিতে পারিনি আমরা ভাগ্যহত”। (রবিহারা) তাঁর ভাবনার জগতের সেই সূর্যসম পুরুষটির সমান মর্যাদাতে তাঁকে স্থান দেবার প্রয়াসকে তিনি খুব প্রসন্নচিত্তে দেখতেন বলে আমার মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর এই অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধকে সম্মান জানাতে হলে, আমি মনে করি, বাংলা কবিতার এই দুই দিকপালকে নিয়ে আলাদা করেই বার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত, একত্রে নয়। আমার স্বদেশী ভাইদের কারো কারো মুখে শুনেছিঃ এঁরা কি কেউ কারো চেয়ে কম? কম কি বেশি সেটা বুঝবার ক্ষমতা অন্তত আমার নেই, এবং যাঁরা বলেন তাঁদেরও নেই বলেই আমার বিশ্বাস। নজরুলের সময়কালে তাঁর পূর্ণ মূল্যায়ন বোধ হয় একটি লোকই করতে পেরেছিলেন সঠিকভাবে—-রবিঠাকুর স্বয়ং। ‘মুসলিম ভারত’ পত্রিকাতে নজরুলের প্রথম জীবনের লেখা ‘শাতিল আরব’ কবিতাটি পড়ার পরই তিনি টের পেয়েছিলেন বাংলা কবিতায় একটি নতুন তারকার উদয় হয়েছে। এবং ওটা নিয়ে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তসহ আরো কিছু ভক্তজনের সাথে আলাপও করেছিলেন। রবিঠাকুরকে অনেকসময় মহাসাগরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তিনি যে কত সুদূরবিস্তৃত মহাসাগর ছিলেন তার কিছুটা আভাস মেলে এই ক্ষুদ্র উদাহরণটি থেকে—-হিন্দুপ্রধান বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যমণি হয়েও তিনি কেমন করে সময় পেতেন বাংগালি মুসলমানদের কে কোথায় কি লিখছেন তাঁর খোঁজ রাখার। সেই আগ্রহটাই বা কেমন করে সৃষ্টি হল তাঁর মনে, সেটাও এক বড় বিস্ময়। কোনও কবির একটিমাত্র কবিতাকে যদি একটা নতুন যুগের অগ্রদূত বলে গণ্য করা যেতে পারে তাহলে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নিশ্চয়ই সে আখ্যাতে ভূষিত হবার যোগ্য। সেটি তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা’তে আত্মপ্রকাশ করার আগে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘বিজলি’ নামক একটি অপেক্ষাকৃত গৌণ সাপ্তাহিক পত্রিকাতে, ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি সংখ্যাতে। পত্রিকাটির সম্পাদক অবিনাশবাবু, নজরুলেরই অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কবিতাটি পড়ার পর এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে কথিত আছে তিনি লাফ দিয়ে উঠে বিস্ময়বিস্ফারিত চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “এ কি করেছ কাজী? এটা তো কবিতা নয়, এটা রীতিমত বিস্ফোরণ”। সত্যি তাই। বিস্ফোরণই বটে। কবিতাটি প্রকাশ হবার সাথে সাথে যেন একটা অগ্নিঝড়ের বজ্রপ্রপাত শুরু হয়ে যায় সমগ্র দেশব্যাপী। বিশেষ করে স্কুল-কলেজে পড়া ছাত্রসমাজ। তাদের দৈনন্দিন আসরে আড্ডায় কফিহাউজে ক্লাসরুমে, বিদ্রোহ আর বিপ্লব ছাড়া আর কোনও আলোচ্য বিষয়ই থাকে না তখন। নজরুলের অগ্নিবাণীর (বল বীর, বল উন্নত মম শির) সাথে সুর মিলিয়ে তারাও বলতে থাকেঃ “আমি কুর্ণিশ করি আমাকেই কেবল”। এই বিদ্রোহ আর বিপ্লবের বজ্রবাণী যেন রবীন্দ্রনাথের প্রবীণ দেহেতেও আন্দোলিত হতে শুরু করে। তিনি সেই দৃপ্ত কন্ঠকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁর সমবেত ভক্তকূলকে বলেনঃ “জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল”। এবং সেই কারণেই তাঁর সদ্যপ্রকাশিত “বসন্ত” গীতিনাট্যখানি উৎসর্গ করেন তরুণ মুসলিম কবি নজরুল ইসলামকে। তাঁর ভক্তদের অনেকেই বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাতেঃ কেন? নজরুল তো কেবল অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনায় তার কাব্যে। বিদ্রোহ আর বৈপ্লবিক বজ্রকন্ঠ দ্বারা সৃষ্ট সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তাই কি সত্যিকার কাব্যপ্রতিভার পরিচায়ক? উত্তেজনার প্রাথমিক আলোড়নটুকু কেটে যাবার পর সেই জনপ্রিয়তাতে ভাঁটা পড়ে যাবে না? “হয়ত যাবে, কিন্তু জনপ্রিয়তাই কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ হতে পারে না। যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য”। বলেছিলেন বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নজরুল যখন হুগলি জেলের ইংরেজ সুপারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন তখন রবিঠাকুর তাঁকে জরুরি বার্তা পাঠিয়েছিলেনঃ “Give up hunger strike. Our literature claims you”. বাংলাসাহিত্যে ঐ একটা সময় ছিল যখন রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে যেন একটা সাংস্কৃতিক সৌরমণ্ডলই গড়ে উঠেছিল। তাঁর কবিতা, তাঁর উপন্যাস, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, সর্বোপরি তাঁর গানের মোহ মূর্ছনার মধ্য দিয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ তাদের প্রাণের স্পন্দন অনুভব করতে পারত, তাঁর কথা ও বাণীর মধ্য দিয়ে তাদের আনন্দবেদনা ও সুখদুঃখের সকল অনুভূতির অনুকম্পন খুঁজে পেত। এবং আজও পায়, আমরা সকলেই তাঁর কবিতা আর গানের মাঝে আমাদের রুদ্ধ আবেগের মুক্তদ্বার সন্ধান করি। আমাদের ভাবনাগুলো তাঁর কথার ভেতর ভাষা পায়। তিনি বাঙালির রক্তস্রোতের ভেতর প্রবেশ করে গিয়েছেন। সেই শান্ত স্নিগ্ধ আবহতে তুমুল এক ঝড়ের বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হলেন এক স্বল্পবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মলব্ধ বিস্ময়পুরুষ নজরুল ইসলাম। আঠারো বছর বয়সে পৌঁছাবার আগেই সেসময়কার কিছু মহাবিপ্লব তাঁর চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে—-তুরস্কের সুলতানশাসিত বন্ধ্যা সমাজে আমূল পরিবর্তন এনে-দেওয়া মহান সেনাপতি মোস্তাফা কামাল আতাতুর্ক, ওদিকে রাশিয়াতে ১৯১৭ সালে সাম্যবাদী চিন্তাধারাতে পূর্ণ-সমর্পিত বলশেভিক বিপ্লব। সাথে সাথে নিজের দেশেও ইংরেজ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসাভিত্তিক নেতৃত্বে। এ সবগুলোরই সম্মিলিত প্রভাব তাঁর মনে তৈরি করে এক প্রবল ঝড়ের আয়োজন। এবং একই সঙ্গে নিত্যচঞ্চল যুবসমাজেও অচলায়তনের প্রাচীর ভেঙ্গে নতুন দিনের আগমনী ঝড়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা দানা বেঁধে ওঠে। তারা নজরুলের বৈপ্লবিক বজ্রবাণীর জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তাই সহসাই তাঁর ‘বিদ্রোহী’ এসে বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবনদুয়ার উন্মুক্ত করে দেয় তাদের মনোজগতে। তারা তাঁকে সাদরে নিজেদের আপনজন হিসেবে বরণ করে নেয়। বাংলা সাহিত্যে এভাবেই সূচিত হয় একটি নতুন যুগ। সে যুগের ধ্বনি যে রবিঠাকুরের প্রাণেও প্রবেশ করেনি তা নয়। তিনি তাঁর ভক্তদের সমাবেশে পরিষ্কার বলেই ফেলেছিলেনঃ “আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই সুর বাজত”। সম্প্রতি নজরুল-বিশারদ তরুণ লেখক সুব্রত কুমার দাস “কাজী নজরুল ইসলাম পূর্বাপর বিবেচনা” শীর্ষক নিবন্ধে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিনয়কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯) নামক জনৈক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত ও বিশ্বপরিব্রাজকের ১৯২২ সালের লেখা The Futurism of Young Asia গ্রন্থ থেকে উৎকলিত Recent Bengali Thought নিবন্ধটিতে। তাতে তিনি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন, এবং ভারতবর্ষ থেকে অনেক দূরে বাস করা সত্ত্বেও (সেসময় তিনি জার্মানীর বার্লিন শহরে বাস করছিলেন) স্বদেশের কাব্যধারার সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। তিনি বার্লিনে বসেই বুঝতে পেরেছিলেন যে ‘নজরুল আধুনিক বাংলা কাব্যের যুগপ্রবর্তক’। শুধু তাই নয়, তিনি এমনও মন্তব্য করেছিলেন যে নজরুলের কবিতার মধ্যে আমেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের (১৮১৯-১৮৯২) প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। প্রতিচ্ছবি যে আছে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় হুইটম্যানের এ-কটি পংক্তির মধ্যেইঃ “I’m as bad as the worst, but, Thank God, I am as good as the best. Do I contradict myself? Very well, then I contradict myself, I am large, I contain multitude.” একই দুর্বিনীত মানিনাকো-কোন-আইনের মনোভাব তো নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছত্রে ছত্রে। সম্প্রতি ক্যাথি স্লুণ্ড-ভিয়ালস নামক আরো এক নজরুলগবেষকের একটি লেখাতে দেখলাম, নজরুলকে হুইটম্যান ছাড়া আরো দুজন বিশ্ববিখ্যাত কবির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছেঃ পাব্লো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩) ও মায়া অ্যাঞ্জেলো (১৯২৮-২০১৪)। এই তিন মহাকবির মত নজরুলকেও তিনি আখ্যায়িত করেছেন মূলত ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-এর কবি বলে। নজরুল ছিলেন আপাদমস্তক একজন মানববাদী কবি, এবং তার সাক্ষ্য হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতাটি (“আমি সাম্যের গান গাই, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাহি কিছু মহিয়ান…”), যেখানে মানুষকে তিনি স্থাপন করেছেন সবকিছুর উর্ধে, যেখানে বিশ্বব্যাপী মানুষে-মানুষে যে সাম্য আর মৈত্রী তার চেয়ে বড় শক্তি আর কোথাও নেই বলে দাবি করেছেন। নজরুলের সাহিত্যসৃষ্টিতে ব্যক্তির এই সর্ববিরাজমানতা ও সার্বভৌমত্বের সাথে জাতিগত সমষ্টিচরিত্রের কি পার্থক্য সেটা অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বস্টনের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইনস্টন ল্যাংলির সুলিখিত ও সুদীর্ঘ রচনাতে। নজরুলের ‘মানুষ’কেন্দ্রিক বিশ্বসাম্য ভাবনার পাশাপাশি তিনি দাঁড় করিয়েছেন স্যামুয়েল হান্টংটনের বিখ্যাত “সভ্যতার সংঘাত” শীর্ষক মতবাদকে। মানবজাতিকে কতিপয় ঐতিহাসিক ‘সভ্যতার’ কৃত্রিম আবেষ্টনীতে আবদ্ধ রেখে তিনি দেখাতে চাইছেন মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে বৃহত্তর ‘সমষ্টি’র তুলনায় গৌণ করে দেখবার প্রবণতা হান্টিংটনের প্রতিপাদ্য ভাষ্যের মাঝে। নজরুলের কাব্যসৃষ্টিতে তার বিপরীত সুরটিই বারবার উচ্চারিত হয়। “সভ্যতার সংঘাত”এ কোনও মানবাধিকার বা ব্যক্তিস্বাধীনতার অবকাশ নাই, যা অত্যন্ত বলিষ্ঠ কন্ঠেই উপস্থিত রয়েছে নজরুলের সৃষ্টিকর্মে, এই মতামতটিই নানাপ্রকারে প্রকাশ করেছেন আমেরিকার এই আফ্রিকান-আমেরিকান প্রফেসারটি। তিনি বলতে চেয়েছেন যে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’তে সেই নগণ্য মানুষটিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বজগতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী প্রাণীরূপে, যার অস্তিত্বের ওপর দণ্ডায়মান পৃথিবীর সকল সভ্যতা। এই অস্তিত্ব দ্বারাই নির্মিত হয়েছে বিশ্বমানবের ধারণা, নির্মিত হয়ে হয়েছে বৃহত্তর মানবপরিবার। এবং এই বিশাল পরিবারের সমান সদস্যদের মাঝে হান্টিংটন-বর্ণিত ‘সভ্যতা’গুলোর অন্তত পাঁচটি সভ্যতার উল্লেখ আছে নজরুলের ‘অগ্রপথিক’ কবিতাটিতে। ল্যাংলি সাহেব বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এই পংক্তিটিতেঃ “আয়ার্ল্যাণ্ড, আরব, মিশর, কোরিয়া, চীন, নরওয়ে, স্পেন, রাশিয়া–সবার ধারি গো ঋণ। সবার রক্তে মোদের লোহুর আভাস পাই, এক বেদনার “কমরেড” ভাই মোরা সবাই। সকল দেশের মোরা সকল! রে চিরযাত্রী পথিকদল, জোর কদম, চল্ রে চল্”। হান্টিংটন সাহেব তাঁর ‘সভ্যতার সংঘাত’ শীর্ষক গ্রন্থটিতে যে সভ্যতাগুলোর ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ঐতিহ্যের পৃথকতা ও সেই পৃথকতার পরিণামে অবশ্যম্ভাবী সংঘাতের ওপর আলোকপাত করেছেন, নজরুলের এই কবিতাতে, ল্যাংলিসাহেব বলতে চেয়েছন যে, ওই জাতিগুলোর ঠিক সেই পৃথকতাগুলোকেই লঙ্ঘন করে “কমরেড”এর আসনে বসানো হয়েছে, আহ্বান জানানো হয়েছে একসাথে পা ফেলে একই লক্ষপথে যাত্রা শুরু করতে–নজরুলের কবিতায় তারা এবং আমরা একই রক্তের বন্ধনে বাঁধা, একই আত্মার আত্মীয়তাতে গ্রন্থিত। সেকারণেই প্রফেসার ল্যাংলি বাঙালি কবি নজরুল ইসলামের কবিতাকে ভবিষ্যৎ সভ্যতার বিশ্বস্ত দিকনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করতে অধিকতর আগ্রহী, হান্টিংটনে সাহেবের সংঘাতের সতর্কবাণী অপেক্ষা। সুব্রত কুমার দাস তাঁর সাম্প্রতিক লেখাটিতে আরো কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন আমাদের, যা হয়ত অনেকেরই জানা ছিল না। নজরুলের কবিতায় বিশ্বব্যাপী কাব্যজগতের কারো কারো সৃষ্টিকর্মের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়, সেটা আমরা একটু আগেই আলোচনা করলাম, যদিও তার অর্থ এ নয় যে নজরুল নিজে এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন (আমার বিশ্বাস যে তিনি তা ছিলেন না)। কিন্তু সুব্রত বাবুর লেখাতেই আমি প্রথম জানলাম যে তাঁর লেখাও ভারত উপমহাদেশের আরো কিছু কবিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এবং এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন নেপালের বিখ্যাত কবি লক্ষ্মীপ্রসাদ দেবকোটা (১৯০৯-১৯৫৯)। তাঁর ‘পাগল’ কবিতাটি ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়, যার সাথে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র পরিষ্কার সামঞ্জস্য খুঁজে পেতে কারু কোনও বেগ পাওয়ার কথা নয়—-একই তেজ, একই দুর্জয় দুর্দম প্রাণশক্তি, একইরকমের মুষ্ঠিবদ্ধ বিদ্রোহের স্পর্ধিত বজ্রবাণী। সুব্রত দাস আক্ষেপের সুরে বলেছেন, বাংলার যেকবিকে সহজেই চিনে নিয়েছেন নেপালের অতিবড় একজন কবি, এবং তাঁর বাণীতেও ধ্বনিতে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন, সেই কবিকে তাঁর নিজের দেশের মানুষ কেন এত দেরি করছেন সঠিক মূল্যায়ন করতে? কবি নজরুলকে ‘যুগের কবি’ বলে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। সুদূর বার্লিনে বসে নজরুলের একটি কবতা পড়েই বিনয়কুমার সরকার তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন ‘ বাংলাকাব্যের যুগপ্রবর্তক’ বলে। তিনি যে সত্যি সত্যি একটা নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন তার প্রমাণ তো সর্বত্র। কবিগুরু যখন গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছেন, বিশ্বজোড়া তাঁর খ্যাতি, ঠিক সেই সময়ই, এই চিরচঞ্চল উদ্ধত যুবক, তাঁরই চরণতলে করুণার আশ্রয়প্রার্থী ভক্তিগদগদচিত্ত ২২ বছর বয়স্ক তরুণ কবি, নিজেরই অজান্তে, কি এক দারুণ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, চারদিক তোলপাড় করে দিয়ে, সম্পূর্ণ নতুন একটা যুগের যবনিকা উন্মোচন করে দিলেন, যাকে কেউ কেউ, পরম ধৃষ্টতায়, নামকরণ করেছিলেন ‘রবীন্দ্রোত্তর যুগ’ বলে! ত্রিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত সাহিত্যজগতে প্রায়ই একটা শব্দ উচ্চারিত হতঃ ‘কল্লোলযুগ’। এই ‘কল্লোলযুগ’ কথাটার কি তাৎপর্য সেটা হয়ত এযুগের সব পাঠক সমান অবগত নন। গত শতাব্দীর বিশের দশকটি একটা উত্তাল সময় ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে। একদিকে ইংরেজ শাসনের দৈনন্দিন অপমান অত্যাচার, সদ্যসমাপ্ত প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ চতুর্দিকে দৃশ্যমান, পশ্চিমে রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব, তুরস্কের আধুনিকীকরণের ঐতিহাসিক বিপ্লব, বিশ্বব্যাপী মার্ক্সিস্ট চিন্তাধারার ব্যাপক বিস্তার, ওদিকে নিজ দেশের ক্রমধূম্রায়মান স্বদেশী আন্দোলনের অগ্নিস্ফূলিঙ্গতে বিস্রস্ত বিচলিত ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ। সাথে সাথে শিল্পসাহিত্যের জগতেও একটা ঝড়পূর্ব থমথমে ভাব–সব মিলিয়ে একটা শ্বাসরোধকর অচলাবস্থা চেপে বসেছিল দেশের তরুণসমাজের ভেতর। যেন একটা খরস্রোতা নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে রাখা হচ্ছিল একটা কৃত্রিম বাঁধের প্রাচীর দাঁড় করিয়ে। ঠিক সেসময়টিতে চারজন শিল্পমনা তরুণ মানুষঃ গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাস, সুনিতা সেন ও মানবেন্দ্রনাথ বাসু–এঁরা মিলে একটা ঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করেন, “ফোর আর্টস ক্লাব” নাম দিয়ে। উদ্দেশ্যঃ সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত ও নাটক, এই চারটে বিষয় নিয়ে সৃষ্টিধর্মী আলোচনা ও নিয়মিত চর্চা। একই সাথে তাঁরা ‘ঝড়ের দোলা’ নাম দিয়ে একটা ছোট গল্পের সংকলন বের করেন, ১৯২২ সালে। ঝড়ের দোলার প্রেরণা নিয়ে দীনেশরঞ্জন দাস ও গোকুলচন্দ্র নাগ, দুবন্ধুতে মিলে একটি সাহিত্যগোষ্ঠী এবং তার সাথে একটা সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন যার নামকরণ করা হয় “কল্লোল”। সালটা ছিল ১৯২৩। তার স্বল্পকাল আগেই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সারা দেশব্যাপী। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই, “কল্লোল”-এর লেখকদের মাঝে প্রথমেই নির্বাচিত হলেন নজরুল ইসলাম। তখন তাঁর বয়স ২৫-এ পৌঁছুবার উপক্রম। তাঁর সাথে যোগ দেন সেসময়কার বিপুল প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন দুজন তরুণতর কবিঃ বুদ্ধদেব বসু, তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৫, আর প্রেমেন্দ্র মিত্র, ২০-এর নিচে। মানে নজরুল ছিলেন তাঁদের ‘অগ্রজ’, সাহিত্যজগতে অবশ্য। পরে আরো দুজন যোগ দেন তাঁদের সঙ্গেঃ গোকুলচন্দ্র নাগ ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। পত্রিকাটির আয়ুষ্কাল ছিল ১৯২৩ থেকে ১৯৩৫। কিন্তু তার প্রভাব থেকে যায় আরো অনেক বছর। এবং কল্লোলের প্রবল ঢেউতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নিরাপদ আসনও সেই তরঙ্গাঘাতের স্পর্শ থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। অনেকটা সেই কারণেই কবিগুরু রচনা করেন তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসঃ ‘শেষের কবিতা’, যা প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়য় ১৯২৮ সালে, মাসিক ‘প্রবাসী’পত্রিকাতে, এবং পরের বছর গ্রন্থাকারে। ‘কল্লোল’ যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তরুণদের মনে, তেমনি রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ও বিপুল সাড়া জাগিয়ে দেয় সারা বাংলাব্যাপী। কল্লোলের তরুণ কন্ঠের উদ্ধত কোলাহলের প্রত্যুত্তরেই যেন তাঁর এই অসাধারণ সৃষ্টি। ‘শেষের কবিতা’র নায়ক অমিত আসলে কল্লোলেরই অন্তর্গত ছিলেন। এই তথ্যগুলো হয়ত কারো অজানা নয়, কিন্তু ততটা জানা হয়ত নয় যে নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সক্রিয়ভাবেই লিপ্ত ছিলেন বিশের দশকের সেই বিখ্যাত ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর সাথে। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে আমরা শুনতাম ‘কল্লোল’ কেমন করে রবীন্দ্রনাথের বলয় অতিক্রম করে একটা গতিশীল নতুন যুগের সূচনা করেছিল বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু তার সাথে নজরুলের নামও যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল সেটা আমাদের জানা ছিল না, অন্তত আমার যে ছিল না সেটা নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি। ১৩০২ সালের ২রা ফাল্গুন রবীন্দ্রনাথ তাঁর অমর কাব্য ‘১৪০০ সাল’ রচনা করেছিলেন। তাতে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন ১০০ বছর পরেও কেউ তাঁর কবিতা পড়তে চাইবে কিনাঃ “আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি, কৌতূহল ভরে আজি হতে শতবর্ষ পরে”। শতবর্ষ তো পার হয়ে গেছে আজ থেকে ২০ বছর আগেই। কই, মানুষ তো এখনও তাঁর কবিতা পড়ছে। ‘কৌতূহল ভরেই’ নয় কেবল, দারুণ আগ্রহভরেই। তাঁর কবিতা, বিশেষ করে তাঁর গান, হয়ত আরো অনেক, অনেক শতবর্ষ পরেও উভয় বাংলার বিদগ্ধজনের প্রাণের কেন্দ্রমূলে অপরূপ সুর বাজিয়ে যাবে, যেমন করে বাজিয়ে চলেছে বিগত শতাব্দীতে। প্রশ্ন হলঃ কবি নজরুলের বেলাতেও ঠিক একইভাবে ‘শতবর্ষ পরের’ প্রশ্নটি উত্থাপন করা একরকম ধৃষ্টতা হয়ে যায় কিনা। হয়ত হয়, অন্তত তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই সেরকমই একটা মত প্রকাশ করতেন। এবং এই প্রজন্মের অধিকাংশ লোকই হয়ত তাই করবেন। কিন্তু প্রশ্নটা কি একেবারেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ছুড়ে ফেলার মত? আমার মনে হয় না। সময় কখন কিভাবে কার কাজের কি মূল্যায়ন করবে কেউ বলতে পারে না। এটা সত্য যে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কাব্যসৃষ্টির প্রকৃতি একরকম নয়।
Posted on: Tue, 25 Nov 2014 22:51:44 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015