প্রবাস অভিজ্ঞতা-২ ছোট্ট - TopicsExpress



          

প্রবাস অভিজ্ঞতা-২ ছোট্ট ঘটনা। সাত আট বছর আগের ঘটনা। টরন্টোর প্রতিটি কাগজের শিরোনাম হয়েছিল। প্রতিক্রিয়ার ঝড় সারা টরন্টো ব্যাপি। ঘটনাটি পুরা টরন্টোবাসীকে কাঁদিয়েছিল সেই সময়। একটি বিড়ালের জন্য মানুষের কান্না। প্রতিটি কাগজে সেই বিড়ালটির ছবি, যার চোখ দুটি কেড়ে নিয়ে ছিল তার প্রভু স্বয়ং। পোষা প্রাণীর উপর মানুষ কেন এতটা নির্দয় হতে পারে তার মনোত্বাস্তিক কারন বের করার চেষ্টাও চলেছিল। টরন্টোবাসীর ঘৃনা উপচে পড়েছিল প্রচণ্ড অপমানে। মানুষ হয়ে কি করে এই কাজ করা সম্ভব হলো? বিচারে সেই পাষান লোকটির কারাদণ্ড ও প্রচুর জরিমানা হয়েছিল। সভ্য সমাজে এরকম ঘটনা মানব জাতির জন্য তীব্র অপমানই বয়ে এনেছিল। বিবর্তনীয় ধারায় আমরা আজ শক্ত প্লাটফর্মে এসে দাড়িয়েছি এবং দুপায়ের প্রাণী হয়ে চার পায়ের প্রাণীদের উপর প্রভুত্ব কায়েম করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করছি প্রতিনিয়ত। আমাদের এই প্রভুত্ববাদী মনোভাব অন্যান প্রাণীর অস্তিত্বকেই শুধু বিপন্ন করছে না, নিজের অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অন্য প্রানীর সংগে মানুষের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কটা কি রকম হতে পারে সেই অভিজ্ঞতাই শুনাব আজ। হ্যামিল্টন, ছোট্ট ছিমছাম শহর। চাকুরী সুত্রে এই শহরে আসা। এই শহরটি দুভাগে বিভাক্ত। আপারহিল আর লোয়ারহিল। আপারে উঠলেই পুরো শহরটিকে এক নজরে দেখা যায়। এই শহরটি ইস্পাত শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এই শহরের পাশেই বার্লিংটন, আরেকটি শহর। সেখানে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন আছে যা দেখার জন্য বহুদূর থেকে অনেক লোক প্রতিদিন আসে। এই গর্ডেনের ছয়টি স্পট আছে, যার এক একটি স্পটের এক এক ধরনের বিশেষত্ব রয়েছে। যা সত্যি আকর্ষনীয়। এখানে প্রায় আমাদের আসা হতো। মুলত প্রকৃতিকেই উপভোগ করার জন্যই আসা। এই সুত্রে একটি পরিবারের সংগে পরিচিত হয়েছিলাম যার শখই ছিল প্রিয় কুকুরটি নিয়ে বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ান। গল্প করতে করতে তার সংগে বাসায় আসা যাওয়ার সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। তিনি প্রকৃতিকে উপভোগ করতেন মনপ্রাণ দিয়ে। এই বাগানের একটি স্পটে ছিল বিচিত্র পাখির বাহার। এখানে কিছু সময় বসলেই জীবনের সমস্ত বিষন্নতা দূর হয়ে যায়। হাত উচু করলেই হাতের উপর ছোট ছোট পাখি এসে বসে মানুষের সংগ উপভোগ করে। সংগে কিছু খাবার নিলে পাখি ও মানুষের মধ্যে খুব সুন্দর সম্পর্ক উপভোগ করা যায়। এবার সেই বিধবা ভদ্রমহিলার প্রসঙ্গে আসি। নাম তার সিনথিয়া জনসন। তার কুকুরটির নাম ছিল জিমি জনসন। তিনি থাকতেন হ্যামিলটনের আপার হিলে। বিশাল বাড়ি। কুকুরটি ছাড়া তার আর কেউ নেই। দশ বছর আগে তার স্বামী মারা যান হার্টএটাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ভয়াবহ এক মানসিক রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিতসায় যখন কিছুই উন্নতি হচ্ছিল না তখন একটি ভিন্ন ব্যবস্তা নেওয়া হয়। তা হলো কুকুর সঙ্গ। কুকুর হলো নিঃসংগ মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু। মানসিক চিকিসার জন্য এটি অতুলনীয়। এখানে নার্সিংহোমে ও হাসপাতালে কুকুর নিয়ে যাওয়া হয় রোগীর কাছে। কুকুরের সংগ অসুস্থ্য মানুষকে মানসিক তৃপ্তি দেয়। এটি এক ধরনের থেরাপি। ভদ্র মহিলার ক্ষেত্রে এটি বেশ কাজে লেগেছিল। এই থেকে কুকুরটি তার সব সময়ের সাথি। এই প্রসংগে নিজের পরিবারের একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়। ১৯৯১ সালের দিকে, আমার এক ভাই হঠাত করে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। এই সময় সে তার প্রিয় পোষা হাস মুরগীর সংগে কথা বলতো। যদিও তার পাশে কোন হাস মুরগীর কোন অস্তিত্ব ছিল না। কেন সে এরকম করতো তা কেহ জানতো না। খুব ছোটকালে তার পোষা হাস মুরগী তার প্রিয় সঙ্গী। হাসের বাচ্চার সঙ্গেই সে আনন্দময় সময় কাটাতো। এডিসনের মত সেও চেষ্টা করে দেখেছিল, নিজেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো যায় কি না। অসুস্থ্য অবস্থায় সে তার প্রিয় প্রানীর সঙ্গই কামনা করতো। আসলে সে ছিল সিজোফ্রেনিক রোগী। এই সব রোগীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা বেশী থাকে। দুঃখের বিষয়, এটিই তার ভাগ্যে ঘটেছিল। নিয়মিত চিকিতসা ও আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করে এদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। এই সব রোগীরা কখনো কখনো অসম্ভব মেধাবীও হয়ে থাকে। সুরের জাদুকর বেটোভেন ও চিত্রশিল্পী ভেনগগ ও এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তারা সমাজকে যা দিয়েছে তা আজ ও মানুষ ভোগ করছে। একটা সমাজ কতটা সভ্য তা নির্ভর করে সেই সমাজে বসবাসকারি নাজুক লোক গুলোর কি অবস্থা তার উপর। বৃদ্ধা, শিশু, নারী, অসুস্থ্য রোগী এরাই সমাজে সবচেয়ে অসহায়। আর এই প্রান্তিক মানুষ গুলোই আমাদের সমাজে সব চেয়ে বেশী নির্যাতিত। মানসিক রোগী হলে তো কথাই নাই। চার পাশের মানুষের অত্যাচারেই জীবনের সমাপ্তি ঘটে যায় অকালেই। এই নির্মম সত্য আমাদের সমাজ গুলোতে দেখা যায়। বিশ্বজিতকেও মরতে হয়েছিল আমাদের মত মানুষের হাতেই। কিন্তু সে তো সমাজের ভঙ্গুর শ্রেনীর ও কেহ না। একজন সাধারন পথচারী। তাহলে কেন হল? যারা শুধু তাকিয়েই ছিল, মুখে না ছিল কোন ভাবের লেশ, তারা কি তাহলে মানুষ? সাধারন মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে এই হত্যার দৃশ্য দেখে কি ভাবে? এদেশে এসে আমি অন্য প্রানীর প্রতি ভালবাসা দেখছি আবার বিশ্বজিতের হত্যার খবর ও পাচ্ছি। এই দুটি পরস্পর বিপরীত মুখি স্রোতের ধাক্কায় মনের জানালাকে ভেংগে চুরমার করছে। সময়ের স্রোতে আবার ঠিক ও হয়ে যাচ্ছি। বিশ্বজিতের হত্যা সভ্য মানুষ হিসাবে আমাদের অবস্থান কোথায় নামিয়েছে তা ইতিহাসই বলে দেবে। যাই হোক আমি সেই কুকুর প্রীতি বৃদ্ধার প্রসঙ্গে আসতে চাই। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন বৈচিত্রময় সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট ছিলেন। আফ্রিকার সংস্কৃতিতে যে সব মিউজিকাল instrument ব্যবহৃত হয়, তার একটা বিশাল সংগ্রহ ছিল। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন জিনিস আমার কাছে জিজ্ঞাসা করতেন। তিনি এক সময় আফ্রিকার বিভিন্ন উন্নয়ন মুলক কাজের সংগে ও যুক্ত ছিলেন। volunteer এখান কার একটি সংস্কৃতি। এদেশে ও স্বেচ্ছা সেবকের অভাব নাই। এদেশের অনেক লোকেই চাকুরীর থেকে অবসর নেওয়ার পরেই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অনেক উন্নয়ন মুলক কাজের সংগে যুক্ত হয়ে পড়ে। সমাজকে কিছু দেওয়া তারা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করে। এখান কার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্ক ধারনা নেওয়ার জন্য আমি ও এই কাজটি করেছিলাম। এটি আমার অনেক উপকারে এসেছিল। volunteering মাধ্যমে অনেক সময় ভাল চাকুরী ও পাওয়া যায় এ দেশে। চলার পথে এক সময় মনে হয়ে ছিল এমন কিছু পড়বো যাতে অনেক টাকা বেতনের চাকুরী পেতে পারি। এখানে মেয়েদের চাকুরীর সুযোগ সুবিধা অনেক বেশী। অনেক তথ্য ঘেটে জানতে পারলাম যে নার্সিংতে সব চেয়ে বেতন বেশী। এবং চাকুরী বাজার সব চেয়ে ভাল। চার বছরের কোর্স নার্সিংতে ভর্তির জন্য প্রিরিকুজিট ছয় মাসের মধ্যে যোগার করি। যদি ও এর আগে আমি বিজ্ঞানের তেমন কিছুই জানতাম না, এই অজুহাতে ১২ গ্রেডের ম্যাথ সায়েন্স পড়া হয়ে ছিল কিন্তু ভর্তি হওয়া আর হয়নি। কারন শুধু টাকার জন্য চার বছর সময় ব্যয় করতে মন সায় দেয় নি। হয় তো ভালই করেছি। টাকা যে কেহর হতে পারে তবে আলোকিত মানুষ হওয়া অনেক কঠিন ও সাধনার ব্যাপার। মানুষ তো পুরাপুরি আলোকিত হতে পারে না তবে কিছুটা আলোর কাছা কাছি আসতে পারে। আমি আমার কাজে বেশ ব্যস্ত হয়ে যাই। পাচ ছয় মাস পরে হঠাত একদিন মনে পরলো বৃদ্ধা খবর নেওয়ার দরকার। ফোন না করেই বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে অবাক। একটা সরকারী নোটিস ঝুলানো। তাহলে বাড়ির তৃতীয় সদস্যের ও মৃত্যু হয়েছে? আমি কিছুই জানতে পারি নাই। দেরি না করেই সেই বিকালের ঝক ঝকে রোদে বের হয়ে পড়ি কবরস্থানের দিকে। কবরস্থানে এসে হতবাক- পাথরে খোদাই করা তিনটি নাম- এডঅয়ার্ড জনসন, সিনথিয়া জনসন ও জিমি জনসন। জিমি জনসন হলো তার সেই প্রিয় কুকুর টি। সে ও আজ একই পরিবারের সদস্যের সংগে চিরনিদ্রায় শায়িত। পাশে গোলাপ গাছ থেকে গোলাপ পাপড়ি গুলো ঝরে পড়ছে তিন সদস্যের কবরের উপর। পশ্চিম আকাশে সুর্য ডুবু ডুবু, তার রক্তিম আভায় চারিদিকে মহিমানিত্ব। যার মহিমায় মহিমানিত্ব হয়েছে জিমি জনসন ও। মানুষের সমান মর্যাদায় বৃদ্ধার পাশে শায়িত হয়ে পৃথিবিকে গর্বিত করে তুলেছে।
Posted on: Mon, 24 Jun 2013 00:45:04 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015