মুক্তিযুদ্ধের চেতনার - TopicsExpress



          

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ছাত্রইউনিয়ন ও ছাত্রলীগঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আদর্শ হল না কেন? নূর মোহাম্মদ কাজী আমরা এখানে বাংলাদেশের জনগনের মুক্তি অর্জনের সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের আদর্শ ও ভুমিকা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। ছাত্রইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ ১৯৭১ সালের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহন করেছিল। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের পর এ উভয় ছাত্র সংগঠন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিজ নিজ আদর্শ হিসেবে নিল না। ছাত্র ইউনিয়ন সমাজতন্ত্র ও ছাত্রলীগ মুজিববাদ কায়েম করতে চাইল। প্রশ্ন জাগতে পারে স্বাধীনতার পর ছাত্রইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ গ্রহন করল না কেন? আদর্শিক সংঘাত চিন্তার সারল্য দিয়ে বিচার করলে আমরা দেখি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে নৃজাতিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের যুদ্ধ। এ আদর্শিক যুদ্ধে বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করেছে। কথা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার দ্বারাই আমরা আমাদের জাতীয় অগ্রগতি সাধান করবো। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে আদর্শিক বিভ্রান্তি দেখা গেল। নুতন সরকার প্রধান ক্ষমতায় বসেই ঘোষণা দিলেন “নকশাল দেখা মাত্র গুলি কর”। স্বাধীনতার উষালগ্নেই ক্ষমতাসীনদের আদর্শিক শত্রু খুঁজে পাওয়া গেল! ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রধান শ্ত্রু এ নকশালদের খোঁজার নামে প্রগতিবাদী ছাত্র-যুবকদের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু করলেন। অথচ এ প্রগতিবাদী ছাত্র-যুবকরাই মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগামী গেরিলাযোদ্ধা ছিলেন। এরাই মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ও আওয়ামি লীগ নেতা-কর্মিদের আত্মদানের সংখ্যা নগন্য। অথচ তাদের ঘোষণায় মনে হলো, নকশালরাই তাদের একমাত্র আদর্শিক শ্ত্রু এবং এ একটি মাত্র সমস্যা সমাধানের জন্যই তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। যার অবশেষ নিঃশেষ করা স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যার জন্য ক্ষমতাসীনরা আরও একটি স্বশস্র যুদ্ধ করার প্রয়োজনীয় ঘোষণা দিলেন। উল্লেখ্য, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ পশ্চিমা আধুনিক সমাজে বিকশিত মতবাদ। ইউরোপীয় রেঁনেসার দার্শনিকগণ নিপীড়িত মানুষ ও জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে এ দু’ মতবাদ প্রস্তাব করেছিলেন। কলোনিয়াল যুগে ইউরোপের এ চিন্তাধারার সাথে আমাদের অগ্রজদের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল কোলকাতায় ছিল। কোলকাতাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ হতে থাকে। এ জাতীয়তাবাদ ছিল ধর্মনির্ভর জাতীয়তাবাদ। আর ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ। কোলকাতার বর্ণহিন্দুরা হিন্দু জাতীয়তাবাদের শক্ত ভীত নির্মাণ করলেন। জাতীয় কংগ্রেসকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পার্টীতে পরিনত করলেন এবং অখন্ড ভারতকে নিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখলেন। এ প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে বংগভংগ হল, বাংলা-আসাম নিয়ে প্রদেশ হল, বংগভংগ প্রতিরোধ আন্দোলন হল, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিস্থিত হল। ১৯১১ সালে আন্দোলনে ভীত হয়ে বৃটিশ সরকার বংগভংগ রহিত করল। হ তাশায় ভেংগে পড়া পুর্ব বাংলার নিপীড়িত বাঙালির জন্য লর্ড কার্জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিলেন। ১৯২১ সালেরর ১ জুলাই পুর্ববাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল। এ দিবস পুর্ববাংলার অসাম্প্রদায়িক “বাঙালি জাতির গৌরব গাঁথা দিবস”। এখান থেকেই পুর্ববাংলার নবীনদের মধ্যে আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ শুরু হয়। এ চেতনা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৪৭সালের ১৪ই আগষ্ট পুর্ববাংলার বাঙালি মুসলমান ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক পুর্বপাকিস্তান অর্জন করল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালিদের যুগে যুগে পরিচিতির নানা স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। এ স্তরগুলু হলোঃ আদি বাঙালি, বাঙালি বৌদ্ধ, বাঙালি মুসলমান, বাঙাল, পাকিস্তানী, বাঙালি ও বাংলাদেশি। মনে রাখতে হবে মানুষের সংঘবদ্ধ পরিচিতি এক একটি ক্ষমতার বলয় নির্মাণ করে। প্রতিটি ক্ষমতার বলয় আবার প্রতিপক্ষ নির্মাণ করে। আদি বাঙালির প্রতিপক্ষ ছিল বাহির থেকে আগত বর্ণবাদী জনগোষ্ঠী। এ বর্ণবাদী জনগোষ্ঠী বাঙালিকে আউট-কাস্ট বলে গণ্য করেছে, চন্ডাল নাম দিয়েছে, অচ্যুত ব লে দূরে থাকার বিধান জারী ক রয়েছে। মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী এসব নীতিকে বাঙালিরা মনে প্রাণে ঘৃণা করেছে, এবং এসব ঘৃনীত ঘোষণার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আদি বাঙালি প্রথমে বৌদ্ধ ধর্ম ও পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে। মানুষ কর্তৃক মানুষের ঘৃণা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আদি বাঙালি ধধ র্ম বিপ্লব করেছে। প্রথমে “বাঙালি বৌদ্ধ” ও পরে “বাঙালি মুসলমান” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বহিরাগত শাসক পাঠান-মোঘলরা এসে বাঙালি মুসলমানকে নুতন পরিচিতি দিলঃ “বাঙাল”। দেশের নাম দিল “বাঙাল মুলুক। প্রধান শাসক নিজেকে “শাহ-ই-বাঙাল” বলে ঘোষণা দিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করলেন। আর সৈন্য বাহিনীর নাম দিলেন “লস্কর-ই- বাঙাল”। তাই বলে বহিরাগতদের সাথে বাঙালি জাতির লড়াই থেমে যায়নি। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজুদৌলার পরাজয়ের পর বাঙালি মুসলমানকে আবার বৃটিশের সাথে ক্ষমতার শেয়ারার বর্ণবাদের প্রতিপক্ষ হতে হলো। পারষ্পরিক ঘৃণার পুরাতন লড়াই আবার শুরু হলো। মুঘলের “বাঙাল” বৃটিশের “বাঙালি মুসলমান” হলো। এ লড়াইয়ে বাঙালি মুসলমান হিসেবে তারা ১৯৪৭ সালে “পাকিস্তানী” পরিচিতি অর্জন করলো। এ পরিচিতি তাদের মনঃপুত হলো না। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানী বাঙালি “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” আন্দোলন করে সোচ্চার কণ্ঠে বললো আমরা ভাষা ও নৃতত্ত্বের দিক থেকে “বাঙালি”। ক্ষমতাসীনদের উর্দ্দু ভাষা আমাদের নয়। এক হাজার মাইল দুরের পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী প্রমাদ গুণল। মুসলমান শাসক হয়ে পাকিস্তানীরা বাঙালি মুসলমানের উপর নিপীড়ন চালালো। বাঙালি মুসলমান দেখলো মুসলমানের নামে বর্ণবাদের আর এক ভয়াবহ প্রকাশ। উপকুলে ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভয়াবহ সাইক্লোনে ১০ লক্ষ বাঙালির মৃত্যুতে পাকিস্তানী শাসকরা দেখালোনা কোন সহানুভুতি। দুর্গত এলাকা ঘুরে এসে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে “২৩শে নভেম্বর জনসভায় দাঁড়ালেন মহান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী। বাঙালি জাতির প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের অবহেলার করুন গাঁথা বর্ণনা করলেন তিনি। এ কারনে “২৩শে নভেম্বর হলো বাঙালি জাতির নিপীড়ণ গাঁথা দিবস”। এ ঘটনার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার সংঘাত দেখা দিল। এ সংঘাত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে রুপ নেয় এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কাঠগড়ায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ কর্মীরা সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকা নিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিল। মুক্তির অর্জনের নীতিগত পার্থক্যের কারনে উভয় সংগঠনের প্রস্তুতি ছিল ভিন্ন ধরনের। এ যুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের বিপরীত আদর্শিক অবস্থান ছিল। ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কেহ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহন করে নাই। ছাত্রলীগের যে নেতারা ১৯৬৯ সালে গনঅভ্যুত্থান ঘটালেন তারা কেন ৯ মাস কোলকাতায় বসে দিন কাটালেন? কেন তাদের স্মৃতিতে রণাংগন নেই? এ প্রশ্ন নবীন প্রজন্মের মনে জাগা স্বাভাবিক। তবে তারা যে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা প্রতিকুলতা সৃষ্টি করেছিল,তা আজ স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল এই বলে যে, তারা সময়মত ছাত্রইউনিয়ন কর্মিদের নির্মূল করার কাজে লাগবে। ছাত্রলীগ নেতারা পরবর্তিতে এ বিষয়টি নানান সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, তারা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর তাদের নির্দেশিত কাজ শুরু করেছিল। এ কারনে স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ নেতাদের কার্যক্রম জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। এদের কার্যক্রম দেখে দেশবাসীর মনে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা প্রদান ও যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল। বাংলাদেশে স্বশাসনের ক্ষেত্রে আজ যে দুর্বলতাগুলু দৃশ্যমান তার পিছনে এ দু’ ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের ভুমিকা রয়েছে। এ কারনে আমরা জাতীয় মুক্তি অর্জনের লড়াইয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভুমিকা কিরুপ ছিল তা পুনর্মুল্যায়ন করতে চাই। প্রশ্ন জেগেছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্রইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলো না কেন? কেন বাঙালিল জাতীয়তাবাদ আজ আসামীর কাঠগড়ায়? আসুন অনুসন্ধান করি। কলোনিয়াল যুগে ইউরোপের এ চিন্তাধারার সাথে আমাদের অগ্রজদের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। বৃটিশ কলোনিয়াল রাজধানী কোলকাতায় গড়ে ঊঠায় কোলকাতাকে কেন্দ্র করে এ জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ হতে থাকে। বিশেষ করে ১৯২১ সালেরর ১ জুলাই পুর্ববাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলের নবীনদের মধ্যে এ জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। এ চিন্তাধারা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৪৭সালের ১৪ই আগষ্ট পুর্ববাংলার মানুষ অর্জন করে মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শ ভিত্তিক পুর্বপাকিস্তান। পরিতাপের বিষয় এই যে, পাকিস্তান ভিত্তিক মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সাথে অচিরেই নৃজাতিক বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শিক সংঘাত দেখা দেয়। এ সংঘাত ১৯৭১ সালে বাঙালি মুসলমানের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রুপ নেয়। এ দিকে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ কর্মীরা সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের পতাকা নিয়ে এ মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিল। মুক্তির অর্জনের নীতিগত পার্থক্যের কারনে উভয় সংগঠনের প্রস্তুতি ছিল ভিন্ন ধরনের। এ যুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের বিপরীত আদর্শিক অবস্থান ছিল। ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কেহ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহন করে নাই। ছাত্রলীগের যে নেতারা ১৯৬৯ সালে গনঅভ্যুত্থান ঘটালেন তারা কেন ৯ মাস কোলকাতায় বসে দিন কাটালেন? কেন তাদের স্মৃতিতে রণাংগন নেই? এ প্রশ্ন নবীন প্রজন্মের মনে জাগা স্বাভাবিক। তবে তারা যে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা প্রতিকুলতা সৃষ্টি করেছিল,তা আজ স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল এই বলে যে, তারা সময়মত ছাত্রইউনিয়ন কর্মিদের নির্মূল করার কাজে লাগবে। ছাত্রলীগ নেতারা পরবর্তিতে এ বিষয়টি নানান সাক্ষাতকারে স্বীকার করেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, তারা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর তাদের নির্দেশিত কাজ শুরু করেছিল। এ কারনে স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ নেতাদের কার্যক্রম জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। এদের কার্যক্রম দেখে দেশবাসীর মনে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা প্রদান ও যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল। বাংলাদেশে স্বশাসনের ক্ষেত্রে আজ যে দুর্বলতাগুলু দৃশ্যমান তার পিছনে এ দু’ ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের ভুমিকা রয়েছে। এ কারনে আমরা জাতীয় মুক্তি অর্জনের লড়াইয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভুমিকা কিরুপ ছিল তা পুনর্মুল্যায়ন করতে চাই। প্রশ্ন জেগেছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্রইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলো না কেন? আমরা আগেই বলেছি ছাত্র ইউনিয়ন আদর্শ হলো সমাজতন্ত্র আর ছাত্র লীগের আদর্শ হলো জাতীয়তাবাদ। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিবের বিভাজনের ফলে ষাটের দশকের শেষ দিকে এসে আমাদের দেশেও ছাত্র ইঊনিয়ন মস্কোপন্থী ও পিকিং পন্থী হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মস্কোপন্থীরা গনন্তান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্র কায়েম ও পিকিং পন্থীরা বিপ্লবের মাধ্যমে নয়া গনতন্ত্র কায়েমের কথা বলে। এ দু’ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা স্বস্ব আদর্শানুসারে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছে। স্বাধীনতার পর প্রথমে ছাত্রলীগ এবং এর পরপরই মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আমার সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধু সোহরাব হাসান ১৯৭২ সালেরয়ে ২৩ শে জুলাই ছাত্রলীগের ভাংগন নিয়ে তার ব্লগে লিখেছেনঃ অবশ্য এর আগে বাহাত্তরের ২৩ জুলাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাত্রলীগ আ স ম রব ও শাজাহান সিরাজ এবং নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন গ্রুপে আনুষ্ঠানিক ভাগ হয়ে যায়। প্রথম গ্রুপ পল্টন ময়দান এবং দ্বিতীয় গ্রুপ রমনা রেসকোর্সে সম্মেলন আহ্বান করে এবং উভয় পক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু তিনি সিদ্দিকী-মাখন গ্রুপের সম্মেলনে গেলেন, রব-শাজাহান সিরাজ গ্রুপের সম্মেলনে গেলেন না। সেই থেকে ছাত্রলীগ ‘মুজিববাদী’ ও ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ নামে দুটি আলাদা সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। সে সময়কার মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম লিখেছেনঃ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের এক বছরের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র মিছিলে প্রথম পুলিশি গুলিবষর্ণ ও ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৩ সালের ১ লা জানুয়ারি। শহীদ হয়েছিলেন মতিউল ইসলাম এবং মীর্জা কাদেরুল ইসলাম। মিছিলটি ছিল ডাকসু ও ছাত্র ইউনিয়নের ঘোষিত ‘ভিয়েতনাম দিবসের’ সংহতি মিছিল। লক্ষ্যনীয় যে, বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার আদর্শের প্রশ্নে ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই নিজস্ব ছাত্র সংগঠন ও বাহিরের ছাত্র সংগঠনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ছাত্র লীগ দু’ভাগ হয়ে এক ভাগ আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করে “মুজিববাদ”, অপর ভাগ আদর্শ হিসেবে ঘোষণা দেয় তাদের আদর্শ হলো “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র”। আর মস্কোপন্থী ছাত্রইউনিয়ন “সমাজতন্ত্র” কায়েমের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ঘোষণা কেরে। এ তিন ছাত্র সংগঠেন নেতা কর্মীরা এক অদৃশ্য সুতার টানে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন “বাঙালি জাতীয়তাবাদী” চেতনাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে। এ প্রেক্ষাপটেই ১৯৭৩ সালে পিকিং পন্থী ছাত্র ইউনিয়নের (বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন) সর্বশেষ বিভাজন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ সংগঠনটি প্রকাশ্যে ভাসানী ন্যাপ ও গোপনে বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টীর সাথে সম্পর্কিত ছিল। আমরা কয়েকজন এ দ্বি-পার্টী সমর্থনের বিরুদ্ধে ছিলাম। উপরন্তু এ সময় বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টী ও জ্যোতি বসুর সিপিএমর সাথে মৈত্রী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার উদ্যেগ নেয়া হয়। আমরা এ মৈত্রীর বিরোধীতা করেছিলাম। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর চিন্তাধারার বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুসারী ছিলাম। এবং ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের আগ্রাসী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নবতর সংগ্রাম গড়ে তোলায় বিশ্বাসী ছিলাম। এ কারনে বাংলার কমিউনিষ্ট পাটির প্রধান কমরেড দেবেন শিকদার আমাকে কমিউনিষ্ট পার্টীর সদস্য হবার অযোগ্য বলে ঘোষনা করলেন। এবং প্রকাশ্যে বললেনঃ -কাজী, তুমি শুধু মালানা মালানা কর, তুমি জান, মালানা ভাসানী এখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষ্যে কথা বলছেন। আর তুমি তাঁর (রাগতস্বরে) রাজনীতি বিশ্বাস কর”। এ নিয়ে কমরেড দেবেন শিকদারের সাথে আমার কিছু কথা কাটাকাটি হয়। আমি বললামঃ - নানা, (কর্মীরা দেবেন শিকদারকে ডাকতো) মওলানা ভাসানী সারা জীবন নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছেন। সি আর দাস-সুভাস বোসকে নেতা মেনেছেন। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝান্ডাকে উর্দ্ধে তুলে ধরেছেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনীতি করেছেন। জোট বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষ্যে সোচ্চার ভুমিকা পালন করেছেন। গনচীনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। আর এখন তিনি কেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করবেন? আমি নানাকে আরও বললাম, নানা, আপনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরে আমাদের ক্যম্পে গিয়ে চীনা জাতির মহান নেতা কমরেড মাওসেতুং এর লাল বই “নয়া গনতন্ত্র” (On New Democracy) আমাদেরকে দিয়েছিলেন। ভিয়েতনামের গেরিলা যুদ্ধের গল্প করেছিলেন। আমরা আপনার দেয়া সেই বই মুখস্ত করেছি এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আর আপনারা এখন বলেন মওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িক। মওলানা ভাসানী ভারত সরকারের বর্ণবাদী নীতি ও সম্প্রসারণবাদী নীতির বিরোধীতা করেছে বলে আপনারা যারা হিন্দু কমিউনিষ্ট তারা একজোট হয়ে এখন মওলানা ভাসানীকে সাম্প্রদায়িক বলা শুরু করেছেন। আমি হিন্দু-মুসলিম কমিউনিষ্ট তত্ত্বে বিশ্বাসী নই। আমি মওলানা ভাসানীর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এ কথা শুনে নানা আমার প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। তদুপরি আমার কমুনিষ্ট পার্টীর সদস্য না হবার পিছনে আরও একটি কারন ছিলো। তা ছিল একটি চটি বই-যা আমি ঢাকায় নিউ মার্কেটের বলাকা সিনামা হলের ফুটপাতের পুরানা বইয়ের দোকান থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। বইটির নাম ছিল “জাতীয়তাবাদ” (Nationalism) ন্যাশনালিজম, লেখক হ্যান্স কোহন ( HANS KOHN)। বইটি ১৯৫৫ সালে লিখা। কমরেড মাওসেতুং এর নয়া গনতন্ত্র ও হ্যান্স কোহনের জাতীয়তাবাদ বই দু’ টি আমার জীবনে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে নয়াদিগন্ত উন্মোচন করেছিল। মওলানা ভাসানীর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত বিরোধের ফলে ১৯৭৩ সালে ভাসানী ন্যাপপন্থী ছাত্র সংগঠন “জাতীয় ছাত্র দল” প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ সময় কমরেড মাওসেতুং এর নয়া গনতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও হ্যান্স কোহনের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা আমাদের মধ্যে কাজ করেছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরপরই অর্জিত “অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী” চেতনার বিপরীতে “মুজিববাদ” প্রতিষ্ঠার যে জোয়ার উঠেছিল তা মূলত ছিল সম্প্রসারণবাদী চক্রান্তের নানা প্রকল্পের আর এক প্রকল্প। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তথাকথিত “বর্ণবাদী কমিউনিউজম” ও “মুজিববাদী সোস্যালিজম” এর আক্রমন থেকে রক্ষার লক্ষ্যে “নয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদী” চেতনার পক্ষ্যে ধবনি তুললাম। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের শেষের দিকে বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে মতভেদের কারনে আমি বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মহানগরী শাখার সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে পদ ত্যাগ করি। এবং প্রতিবাদ স্বরূপ নয়া জাতীয়তাবাদী ধারনার ভিত্তিতে আমরা ১৯৭৩ সালে ভাসানী ন্যাপের ছাত্র সংগঠন “জাতীয় ছাত্রদল” গড়ে তুলি। মুলতঃ আমার তাগিদেই পুর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারন সম্পাদক জনাব নজমুল হক নান্নু জাতীয় ছাত্রদলের ঘোষনা পত্র রচনা করেন। এ ঘোষণাপত্রে আমরা জাতীয় পুঁজি বিকাশের লক্ষ্যে “জাতীয়মুক্তি”, “স্বাধীনতা” ও “গনতন্ত্র” প্রতিষ্ঠাকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহন করি। সাম্রজ্যবাদ, সম্প্রসারনবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামকে অব্যাহত রেখে আমরা অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করি। নয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের ব্রুন এ ভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল। এ সংগঠনের পতাকা তলে আমরা ভারতীয় সম্প্রসারনবাদ বিরোধী এক নয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তুললাম। ১৯৭৩ সালের ২৩শে জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি, এস, সি তে আয়োজিত সারা দেশ থেকে আগত ভাসানী ন্যাপ অনুসারী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের এক মহাসম্মেলনে “জাতীয় ছাত্রদল” প্রতিষ্ঠার ঘোষনা প্রদান করা হয়েছিল। এ নয়া জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উন্মেষক্ষনেই বিনাশ করার লক্ষ্যে এদিন ছাত্রলীগের কর্মিরা “বিশ্বে এলো নুতনবাদ –মুজিববাদ, মুজিববাদ” (বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আড়াল করার আদর্শবাদ) শ্লোগান দিয়ে আমাদের উপর চড়াও হয়েছিল। তারা ভাসানী ন্যাপের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়াকে টি এস সির সামনে এলে শারিরীকভাবে নাজেহাল করল। আমাকে গুলি করার জন্য পিস্টল নিয়ে তাড়া করল। আমি ছাত্রলীগের হুমকির মুখে জীবনবাজী রেখে সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী জয়োধবনি “জয় বাংলা-জয় বাংলাদেশ” শ্লোগান দিয়েছিলাম। এ শ্লোগান ছিল ছাত্রলীগের লীগের তথাকথিত মুজিববাদী শ্লোগানের বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সংহত করনের শ্লোগান। এ শ্লোগান ছিল নয়া বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনা বিকাশের ভিত্তি স্থাপনকারী শ্লোগান। জাতীয় ছাত্রদল প্রতিষ্ঠার মাসাধিক কাল পর ১৯৭৩ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংদের (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপুর্ন ঘটনা। এ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশি চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অপাংতেয় করে তোলে। এ নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের যৌথ প্যানেল ছিল (লেলিন-গামা পরিষদ), বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগের প্যানেল ছিল (মাহবুব-মান্না পরিষদ), আর জাতীয়তাবাদী চেতনার প্যানেল ছিল ভাসানীপন্থী ন্যাপের জাতীয় ছাত্রদলের (বাবু-কাজী পরিষদ-ফজলুর রহমান বাবু ও নূর মোহাম্মদ কাজী) এ নির্বাচনে মুজিবাদী ছাত্রলীগ কর্মীরা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে। ফলে নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়। তবে জাতীয় ছাত্রদল আধিপত্যবাদ বিরোধী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের পক্ষে দৃঢ় মতামত নিয়ে দাঁড়ানোর কারনে দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। ১৯৭৬ সাল নাগাদ নয়া বাঙালী জাতীয়বাদের পতাকাবাহী জাতীয় ছাত্রদল সারাদেশের শিক্ষাংগনে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ছাত্র-যুবকদের উদ্দীপনায় এ সময় ভাসানী ন্যাপের ভিত্তি শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠছিল। এ পর্যায়ে জাতীয় ছাত্রদল নেতৃত্বের একাংশ অজ্ঞাত কারনে সম্প্রসারনবাদ বিরোধীতা ত্যাগের প্রশ্ন তোলে। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের আগ্রাসী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নবতর সংগ্রাম গড়ে তোলায় বিশ্বাসী ছিলাম। জাতীয় ছাত্রদলের আমার এ বন্ধুরা “ভারতীয় সম্প্রসারনবাদ” শব্দটি ঘোষণা পত্র থেকে বাদ দিতে চায়। এ বিষয়টি নিয়ে ১৯৭৬ সালের প্রথম থেকে আমাদের মধ্যে মতান্তর দেখা দেয়। জাতীয় ছাত্রদলের ৭ সদস্যের সর্বোচ্চ কমিটির মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারন করে। কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন নুর মোহাম্মদ খান, ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ঢাকা মহানগরী সভাপতি নুর মোহাম্মদ কাজী, সাধারন সম্পাদক জনাব জিয়াউল হক মিলু হক (অব্যাহতি চেয়েছেন), যূগ্ম সম্পাদক মিয়া শহীদ হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সদস্য সর্বজনাব ইফতেখার আহমদ চৌধুরী, মোবারক হোসাইন, শামসুজ্জামান মিলন ও আওকাত হোসাইন। সম্প্রসারনবাদ বিরোধী আন্দোলনকে যে কোন মুল্যে এগিয়ে নেবার প্রত্যয় ঘোষনা করায় কমিটির অপর চার জন অগঠনতান্ত্রিক পদ্ধিতে আমাদের তিনজনকে বহিস্কার করে। আমরা তিনজন হলামঃ নুর মোহাম্মদ কাজী (আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আখতার মুকুল, পৃঃ ৩৭০), ইফতেখার আহমদ চৌধুরী ও সামসুজ্জামান মিলন। ছাত্র ইউনিয়নের সংগ্রামী ধারাবাহিকতা রক্ষার লক্ষ্যে আমরা ১৯৭৭ সালে জাতীয় ছাত্র ইউনিয়ন (নুর মোহাম্মদ কাজী) প্রতিষ্ঠা করলাম। অপর অংশ বি এন পির সাথে গিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গঠন করে। প্রথমেই আমি বলেছি জাতীয়মুক্তি, স্বাধীনতা ও গনতন্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সামাজিক স্বপ্নের মধ্যে ভিন্নতা ছিল। ছাত্রলীগ বহিরাগত শক্তির যোগ সাজসে দেশ চালানোকে পরাধীনতা মনে করে না। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির পাহারাদান ও সামাজিক বৈষম্যকে অব্যাহত রাখাটাকে তারা তাদের আদর্শিক কর্ম বলে মনে করে। আর ছাত্র ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে এবং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে লড়াই করে। ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের মধ্যে মুক্তির স্বপ্ন (Imagination of Liberation) নিয়ে যে পার্থক্য ছিল, তাতে ছাত্রলীগের স্বপ্ন সফল হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের স্বপ্ন সফল হয়নি। দ্বিধা বিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নের নরমপন্থীরা (Soft Liner) ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে ভিয়েতনাম দিবস ঘোষণা দিয়ে মাঠ গরম করে তুললেন। দু’জন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মি শহীদ হলেন। স্বাধীনতার উষালগ্নে ঘটা এ ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগ নেতারা প্রমাদ গুণলেন, আপোষ করলেন এবং ভারত-রাশিয়ার বন্ধু-প্রতীম ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে আঁতাত করে দেশ চালাতে বাধ্য হলেন। এ দিকে ছাত্রইউনিয়নের কঠোর পন্থীরা ( Hard Liner) এ আঁতাতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন এবং নয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানালেন। ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে আওয়ামি লীগের আঁতাত ছাত্রলীগের স্বপ্নের সমান্তরাল ছিল। এ কারনে ছাত্রলীগ ও নরমপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীনতা অর্জনের বিজয়ের দাবীদার হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিলেন। ছাত্রলীগ কর্মীদের মতে “আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে আসছি। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ আমাদের নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ৯ মাসব্যাপী এক রক্তক্ষয়ী স্বশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ভারত ও রাশিয়া আমাদেরকে এ স্বাধীনতা অর্জনে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। এ জন্য এ দেশ দু’টির জনগনের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের দেশকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা করে আসছে”। আর ছাত্র ইউনিয়নের আদর্শিক কর্মি হিসেবে আমাদের বক্তব্য ছিল এই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই উপকৃত হয় নাই, ভারতও এ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। ভারতের পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা বড়ই হিতকর হয়েছে। পুর্ব ভারতে নকশাল আন্দোলন ও কমিউনিষ্ট উত্থানকে দমন করা সহজ হয়েছে। গংগা নদীর পানির নিরংকুশ ব্যাবহার ও বাংলাদেশের সকল নদীর পানি চুষে নেবার ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এ কারনে দিল্লীর সরকার আজো বাংলাদেশের শাসক শ্রেনীকে বিজয়ী শ্রেনী হিসেবে দেখছে এবং এখানকার সরকারকে বিন্যস্থ করার ব্যাপারে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনে দিল্লীর প্রভাব আমাদের এ সব বিজয়ী সরকারগুলু অস্বীকার করতে পারে না। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে দু’টি দেশের কায়েমী স্বার্থ রক্ষা ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দমনের লক্ষ্যে দু’টি ধর্মকে ব্যবহার করেছিল। যা আজো অব্যাহত রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী জমিদার-আমলাতন্ত্র-বংশস্বার্থ রক্ষাকারী এক প্রবল ক্ষমতাবান শ্রেণী। এ দু’ দেশের শাসক শ্রেণীর মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। রয়েছে সখ্যতা ও বন্ধুত্ব। ভারত ও পাকিস্তানের জাতি-স্বত্তাগুলোর মধ্যে গড়ে উঠা স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করাই উভয় দেশের এ শাসক শ্রেণীর পবিত্র কর্তব্য। এ কারনে ভারত ও পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী নিপীড়িত মানুষদের দ্বারা গড়ে উঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আখ্যায়িত করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে দমন করে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগতে পারে তবে কেন ভারত পূর্ব বাংলার বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগীতা করবে? মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের সরকারের দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। সেই আন্দোলনকে কেন সহযোগিতা করেছিল ভারত? কেন অংশগ্রহণ করেছিল এ যুদ্ধে ? এর যথার্থ ব্যাখ্যা বাংলাদেশের ক্ষমতার তালুকদাররা দেন না। কারন বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর স্বার্থ আর ভারত ও পাকিস্তানের শাসক শ্রেনীর স্বার্থ একই সূতায় গাঁথা। আর যারা বাঙালি জাতির প্রকৃত জাতীয় মুক্তির জন্য ল্ড়াই শুরু করেছিল, তাদের লক্ষ্য ও স্বার্থ ছিল আলাদা। বাংলাদেশের শাসক ও শাসিতদের মধ্যকার এ বিরোধের ফাটল দিনে দিনে বিস্তৃত হচ্ছে। দৃশ্যমান এ ফাটল আড়াল করার জন্য বিগত ৪২ বছর ধরে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী নিরাপদ শ্রেনী স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে দ্বি-পার্টী ক্ষমতা বলয় তৈরী করে মরিয়া হয়ে কাজ করছে। এদের লক্ষ্য ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান ও ভারতের অনুরুপ বাংলাদেশেও পুঁজিপতি-আমলাতন্ত্র-বংশস্বার্থ ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা। উল্লেখ্য ১৯৫০ সালে বাংলাদেশে জমিদারী অধিগ্রহন আইন কার্যকর হওয়ায় দৃশ্যতঃ জমিদার শ্রেণী এখন আর নাই। তবে জমিদার শ্রেণীর স্থান দখল করেছে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতি শ্রেণী। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী যেহেতু পাকিস্তান ও ভারতের শাসক শ্রেণীর ধারাবাহিকতা অনুসারী, সেহেতু এখানকার পুঁজিপতি-আমলাতন্ত্র-বংশস্বার্থ রক্ষাকাংখী ক্ষমতাসীন শ্রেণী ধর্মকে বার বার আদর্শ হিসেবে সামনে নিয়ে আসছে। দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলুতে শ্রেণীস্বার্থ রক্ষায় ধর্মের বিকল্প নেই। উল্লেক্ষ্য, এসব দেশের জনগন ধর্মের ভুবন (Religion) ছেড়ে কখনো কার্য-কারনের ভুবনে (Reason) উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের পুঁজিপতি-আমলাতন্ত্র-বংশস্বার্থ রক্ষাকাংখী ক্ষমতাসীন শ্রেণী ধর্মের মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহারকে অপরিহার্য মনে করছে। একারনে শাসক শ্রেণী রাষ্ট্রের সমগ্র প্রশাসন যন্ত্র দিয়ে ধর্ম সচেতনতার (Conscientization) ভিত গড়ে তুলছে। এ লক্ষ্যেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শ্রেণী (সরকারী ও বিরোধী দল) বিগত চারদশক ধরে রিলে রেইচের মত ক্ষমতার হাত বদলাচ্ছে এবং ধর্মকে রাজনীতির ক্ষেত্রে আদর্শিক প্রতিযোগী (Contexual) করে তোলার খেলায় মেতে আছে। এখানে প্রাসংগিক হবে বলে আমার নিজের একটি স্মৃতি কথা বর্ণনা করতে চাই। ছাত্র ইউনিয়নের আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি নিজ এলাকা চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলাম। ফরিদ্গঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসার সামনে অবস্থিত শহীদ মিনার প্রাংগনে আয়োজিত জনসভা শেষে আমি পুর্ব বাংলার ম্যাপ অংকিত পতাকা উত্তোলন করি। এ সময় আমার পাশে ছিলেন ফরিদ্গঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব সিরাজ মিয়া ও সেক্রেটারী আমিনুল হক মাস্টার। এলাকায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের কাফফারা আমাকে কঠিনভাবে দিতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত ৪২ বছর যাবত আমি নিজ বাড়িতে গিয়ে এক রাত ঘুমাতে পারিনি। সে কাহিনী বেদনা দায়ক। স্বাধীনতার পরপরই আমি বিস্ময়ে কাতর হয়ে দেখেছি, জহুরা তাজউদ্দিনের আত্মীয় মওলানা মান্নান স্বাধীনতার বিরোধীতা করা স্বত্ত্বেও স্বাধীনতার কিছুকাল পরই পুনরায় ফরিদগঞ্জ এলাকার রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে গেলেন। আর তার বড় সহযোগী হলেন বাজারের বড় মিস্টির দোকানদার কৃষ্ণকানাই। এরপর এ মওলানা মান্নানই বহুবার এম পি ও দুই দুইবার বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রী হলেন! তার পুত্রকে তিনি আওয়ামি লীগে ভর্তি করে দিয়ে ইন্তেকাল করলেন। এখন এলাকার অনেক আওয়ামি লীগ নেতা ঢাকায় তার কবর জিয়ারত করতে যান আর সেখানে গিয়ে অজিফা পাঠ করেন। যাক, প্রসংগক্রমে আমি এখানে মহান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর জীবনীকার প্রখ্যাত সমাজ গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের কয়েকটি বাক্য কোর্ট করছিঃ জামায়াতে ইসলামীর মতো ভাগ্যবান দল পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই। তারা পেল বাংলাদেশে শাসনক্ষমতার স্বাদ। যে মাওলানা মান্নানকে পত্রিকায় ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে বাহাত্তরের জানুয়ারিতে আমরা খুঁজেছি, তাঁকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এসে জিয়াউর রহমান প্রতিমন্ত্রী বানালেন। সেটাও তাঁর উপযুক্ত পদ হলো না। জেনারেল এরশাদ তাঁকে বানালেন পূর্ণ মন্ত্রী। তাঁর পুত্র যেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে চীন সফরে গেলেন, সেদিন শহীদ চক্ষুবিশেষজ্ঞ আলীম চৌধুরীর আত্মা রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে আর্তনাদ করে উঠেছিল। (রেফাঃ সৈয়দ আবুল মকসুদের ফেইচ বুক একাউন্ট) পরিশেষে আমরা বলতে চাই, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মি হিসেবে আমরা নিপীড়িত বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা পুর্ণ বিজয় অর্জন করি নাই। মুক্তি সংগ্রাম অব্যহত রাখার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ২৩শে জুলাই আমরা জাতীয় ছাত্রদল গড়ে তুলেছিলাম। জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের স্বপ্ন-মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলাম এবং শ্লোগান দিয়েছিলাম “নয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদ- জিন্দাবাদ”। আমাদের আন্দোলন ছিল মুলতঃ সম্প্রসারনবাদ বিরোধী আন্দোলন। এ আন্দোলন করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমরা যেন মাকড়শার জালে আটকে গেছি। সম্প্রসারনবাদের জাল পাতা রয়েছে প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। বাংলাদেশে এ জাল বিস্তারকারী ও রক্ষাকারীর অভাব নাই। গত ৪২ বছর যাবত যারাই বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে বশংবদ সরকারগুলু তাদের শাস্তি দিয়েছে। “চরমপন্থি” বলে খতমের দায়িত্ব পালন করেছে। এসব কারনে ৪০ হাজার মেধাবী ছাত্র-যুবক ও মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার পর হত্যাকান্ডের শিকারে পরিনত হয়েছে। অথচ ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ্যে ছিল আজ তারা ক্ষমতার ভাগীদার। মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানেরর মাজার ঢাকায় হলো না? এ রহস্য একদিন হয়তো বা কোন গবেষক বের করবেন। কেনই বা হাসিনা-খালেদা-জিয়া-এরশাদরা মহান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর মাজার জিয়ারতে যান না? তবে কি কবরে শায়িত মওলানা ভাসানী আজও জাতিকে পথের দিশা দেখাচ্ছেন? যে পথের দিশা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের জন্য হয় তো বা পথের কাঁটা! তাই বলে কি বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে চলমান মুক্তি সংগ্রাম ছেড়ে দেবে? না। আমরা জানি, আমাদের রক্তধারা বলছে, বীর বাঙালির ইতিহাস, লড়াই করে বাঁচার ইতিহাস। লড়াই করে সামনে এগিয়ে যাবার ইতিহাস। আর যারা আপোষকামী, খুঁজে দেখুন তারা বহিরাগত। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের ভিত্তিমুল ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাবোধ। বাংলাদেশে স্বশাসনের ক্ষেত্রে আজ যে দুর্বলতা তার কারন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে থেকে নবপ্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে তোলার ক্রমাগত চক্রান্ত। বুদ্ধিজীবী হত্যা থেকে শুরু করা হয়েছিল বাঙালি জাতি হত্যার চক্রান্ত। স্বাধীনতার পর জাতি হত্যার কাজ শুরু হয় আদর্শ বিভ্রান্তির মাধ্যমে। ছাত্র সংগঠনগুলু আজ জাতীয়তাবোধহীন, দেশ প্রেমহীন সন্ত্রাসী সংঠনে পরিনত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলুর নেতাদের সাথে দেশের সাধারন মানুষের কোন সম্পৃক্ততা নেই। নেতারা বাইরের শক্তির মদদে ক্ষমতায় বসতে চায়। এজন্য এরা মিডিয়ায় তোতা পাখীর বয়ান দেয়। এদের বয়ানে জাতীয় নিপীড়ন গাঁথা ও গৌরব গাঁথা নেই। আছে পারিবারিক নেতাদের বয়ান। এভাবে ১৬ কোটি বাঙালি বাঁচবে না। বাঙালি জাতি বাঁচবে না। বাংলাদেশ বাঁচবে না। বাংলাদেশের জ্ঞাতি-প্রতিবেশীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
Posted on: Fri, 27 Sep 2013 03:48:39 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015