সীমার বাইরে ----------------------- - TopicsExpress



          

সীমার বাইরে ----------------------- গোধূলি বিশ্বাস সীজন ম্যাগাজিনের সম্পাদক রায়হান চৌধুরী এসে আলপনাকে বললেন- আলপনা, নেক্সট কলামের ব্যাপারে কিছু ঠিক করেছো ? ভাবছিলাম, জেরিন মির্জার সাক্ষাৎকার নেব । না না, ওসব ডানাওয়ালা রাইটারদের জায়গা হবে না আমাদের ম্যাগাজিনে । তবে,স্যার, আপনি কার সাক্ষাৎকার চাচ্ছেন? আজকাল পেপার-পত্রিকায় নজর রাখছো তো? আমাদের দেশের এক প্রফেসর ফ্রান্সের এক কনফারেন্সে ব্যাপক হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন । প্রফেসর আমজাদ ব্যাতিক্রমধর্মী কিছু আলোচনার মাধ্যমে ঝড় তুলেছেন ঐ দেশের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকের মাঝে । উনাকে নিয়েই চাচ্ছি । স্যার, Appointment কি পাবো? আল-প-না,উনি দেশে ফেরার আগেই Appointmentএর জন্য বলে রেখেছিলাম। হুদাই তো ম্যাগাজিনের সম্পাদক নই আমি। ওকে, স্যার। শোনো, পরশু ওনার সাথে তোমার Appointment। আমি চাই-তুমি ওনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য- জানি স্যার, বলতে হবে না । আলপনা বাসায় ফিরেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঘাটাঘাটি করলো। ঘাটতে ঘাটতে একটা অখ্যাত পত্রিকার ওয়েবসাইটে ঢুকলো। ঐ ওয়েবসাইটে প্রফেসর আমজাদের পাঁচবছর আগের একটি সাক্ষাৎকার আছে, যখন প্রফেসরকে কেউ চিনতো না। প্রফেসর আমজাদ ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করলেও সেটাকে Historical psychology বলাই ভাল হবে। ওনাকে নিয়ে লেখা কলামটার শিরোনামই যথেষ্ট যে কাউকে আকৃষ্ট করতে। সেটি হলো-প্রফেসর আমজাদের বিকৃত ভালবাসা। অদ্ভুত সব কথা প্রফেসরের । ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন- নিউটন বলেছেন, পৃথিবীতে সবই আপেক্ষিক, কোন কিছুই পরম নয় । এটা আবেগ-অনুভূতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আজকাল মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভালবাসার কাহিনী হয় । মোবাইল ফোনে যে প্রেম হয়, তার ভিত্তি কি ? ভয়েস? ভালবাসা কি দুটো ভয়েসের মধ্যে? ভয়েস চিপ ব্যবহার করে ভয়েস চেঞ্জ পসিবল । আগে চিঠি আদান-প্রদানে প্রেম হতো। ভালবাসা কি দুটো হাতের লেখার মধ্যে না লেখার কথার মধ্যে ? অন্যজনকে দিয়ে চিঠি লেখানোর ঘটনাও বিরল নয় । যে লিখতে পারে না,তার কি হবে? Love at first sight-যে দেখতে পারে না,তার কি হবে? অন্ধ, বোবা-বধিরদের কি আবেগ-অনুভূতি নেই? তাহলে ভালবাসার Basis টা কী? আমরা যাকে ভালবাসা বলি, তা কি আদৌ ভালবাসা? নাকি সুন্দর সময় যাপন মাত্র? ভালবাসা কি এতোই available,এতোই cheap? তাহলে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ? ভালবাসার Basis কী? মানবতা। মানে? আপনি কি ভালবেসেছেন কখনো? বেসেছি,বাসছি এবং বাসবো। ভালবেসেই তো বেঁচে আছি। যেই ছোটছেলেটি তার ছোটবোনের খিদে মিটাতে গিয়ে রাস্তার দোকান থেকে পাউরুটি চুরির দায়ে মার খায়, সেই ছেলেটিকে ভালবাসি। প্রতারিত হয়ে যে মা তার নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে ইট ভাঙ্গে, তাকে ভালবাসি। ভালবাসা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। মনে পড়ে যায়, স্টুডেন্টলাইফে একবার একজনের চিকিৎসার সাহায্যের জন্য টাকা তুলতে গিয়েছিলাম বানিজ্যমেলায়। তখন শীতকাল। কেউ আসছিলই না। তাকিয়ে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিলো। আমাদের মধ্যেই একজন টাকা দিয়ে লোকজনকে initiate করার চেষ্টা করল। প্রথম প্রথম ২টাকা,৫টাকা । মেলার লোকজনের মধ্যে আমি থাকলে একটাকাও দিতাম কিনা সন্দেহ। খানিকক্ষণ পরেই দেখলাম তিনটা পথশিশু হেঁটে যাচ্ছে, সোজা ভাষায় টোকাই। আমাদের সাথে আমার এক স্কুলফ্রেন্ড ছিল, বর্তমানে যে কিনা ডঃ টোকাই নামেই পরিচিত। আমার বন্ধুবেচারার বাবার মাথা খানিকটা খারাপ ছিল,ছেলের নাম রেখেছিলেন টোকাই। আমরা সবাই মিলে টোকাই টোকাই বলে ওকে নানাভাবে গুতো মারতে লাগলাম । হঠাৎ খেয়াল করলাম, পথশিশুগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে একজন দগ্ধ শিশু, যার মাথার উপরের দিকে একপাশে খানিকটা অংশ পুড়ে যাওয়া এবং ঐ অংশে চুল নেই, গায়ে ময়লা গেঞ্জি, ময়লা ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট। ছেলেটির বয়স ৫-৬ বছরের বেশি হবে না। দগ্ধ হলেও সুন্দর, কোমলতা ও নিস্পাপভাব চেহারায়। ভাবলাম, টোকাইগুলো আমাদের খালিবাক্সের মজা নিতে আসছে বুঝি। দগ্ধশিশুটি এগিয়ে এলো আমার দিকে। দেখলাম, শীতে সে ঠিরঠির করে কাঁপছে। আমাদের সবার গায়ে শীতের কাপড়, আমারই সবচেয়ে বেশি। মাথায় মাফলার, গায়ে চাদর, হাতেপায়ে মোজা। শিশুটির হাতে একটা ১০টাকা ও ৫টাকার নোট। ও সুন্দর করে ওর ৫টাকার নোটটি এগিয়ে দিলো। আমি স্তব্ধ, নিচু হয়ে যন্ত্রের মতো হাতের বাক্সটা এগিয়ে দিলাম, মুখ দিয়ে ধন্যবাদ কথাটাও বের হলো না। স্তব্ধতা ভাঙল আরেক ভিখারি মহিলার অশ্রাব্য গালি শুনে, তার ব্যবসার লালবাতি জালাচ্ছিলাম আমরা। কি ক্ষুদ্র আমি মনে হলো।আজো ভুলি নি শিশুটির চেহারা। হোক পোড়া, ও দেবশিশু। মুহূর্তেই ভালবেসেছিলাম শিশুটিকে। এরপর যতবারই মেলায় গেছি, ঐ শিশুটিকে খুঁজেছি। আহা,ঐ ভালবাসা না,প্রেম-ভালবাসার কাহিনী নেই আপনার জীবনে? আছে,আছে। কেন থাকবে না? আমার চশমাটি দেখছেন? চশমার পাওয়ার ছোটকাল থেকেই বেশ ছিল। চশমা ছাড়া আমার দুনিয়া ঝাপসা। আর চশমা থেকেই প্রেমের সূত্রপাত।মাস্টার্স শেষ করে চাকরি খুঁজছি। আমার চাকরি জুটছিল না, ঐ ফাঁকে প্র্যাক্তন প্রেমিকার বিয়ের দাওয়াতও জুটে গেল। ঢাকাশহরের চিরায়ত ব্যস্ত একটি দিনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অন্য পথচারীদের সাথে রাস্তা ক্রস করবার জন্য। সবাই ব্যস্ত। রাস্তা ক্রস করবার সময় এক ব্যস্ত পথচারীর ধাক্কা খেলাম, চোখের চশমাটি পড়ে গেলো। আমি রাস্তার মাঝখানে, ঝাপসা চারদিক। গাড়ির হর্নের শব্দ শুনছি। হঠাৎ কোমল একটা হাত আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল রাস্তার অন্যপাশে। বুঝলাম না কে সে? শুধু ঝাপসা দেখলাম, গাঢ় নীল রঙের শাড়ীপরা এক তরুণীর অবয়ব। আমি বলতে লাগলাম, আমি চশমা ছাড়া কিছু দেখি না। প্লিজ, কেউ আমার চশমাটা এনে দিন। মেয়েটি বলল,দাঁড়ান আনছি। ঐ পরিস্থিতিতে মেয়েটার কণ্ঠস্বরও খেয়াল করি নি। মেয়েটি গেল চশমা আনতে। ততক্ষণে সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। আর্তনাদ শুনলাম। তারপর ঠিক কি হল মনে নেই। ঘোর থেকে বের হতে না হতেই দেখি আমি পুলিশ স্টেশনে। দুতিন ঘণ্টা টানা হতভম্ব ছিলাম। টানা একমাস বাসা থেকে বের হই নি। মা ঐ মাসের সব পেপার-পত্রিকা সরিয়ে ফেলেছিল। এর মধ্যে টোকাইএসেছিল আমাকে দেখতে। ওর সাথে ঠিক কি কি কথা হয়েছিল-মনে নেই। পুরো মাস জুড়ে স্বপ্ন দেখতাম, ঝাপসা স্বপ্ন, নীলশাড়ীপরা মেয়েটি এগিয়ে আসছে চশমা হাতে আর বলছে,এই তো চশমা। ভুলতেই পারছিলাম না মেয়েটিকে। ভালবেসে ফেললাম। কিছুটা নরমাল হবার পর আগের মাসের সব পেপার যোগাড় করে মেয়েটার সব নিউজ, ছবি কাটিং করে রাখতাম। দিনের পর দিন মেয়েটার ছবি নিয়ে পড়ে থাকতাম অন্ধকার ঘরে। মেয়েটিকে সামনাসামনি দেখেছিলাম ঝাপসা আর দেখেছিলাম পেপারের ঐ ফটো। ওর ডেডবডিও নাকি দেখেছি আমি,থেতলে যাওয়া...। ঝাপসা সপ্নের পাশাপাশি স্পষ্ট স্বপ্নও দেখতে শুরু করলাম। আমার স্বপ্নগুলোতে দ্বিমাত্রিক ছবির মেয়েটি ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠত, পরনে সেই নীল শাড়ী, মেঘডম্বর শাড়ী, এসে হাত ধরে বলতো,তুমি বেঁচে আছো,এর থেকে বেশি চাওয়া আমার নেই। আরো কতো স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে ওর হাতধরে হেঁটে গেছি রেললাইনের উপর দিয়ে। নাম বলবো না সেই নীলাম্বরীর। ঘর-সংসারের স্বপ্নও দেখেছি যদিও মেয়েটি ছিল সদ্যবিবাহিতা। বিকৃত ভালবাসার গল্প মনে হতে পারে আপনার। আমি ভেলবেসেছি এমন একজনকে, যাকে ঝাপসা দেখেছি, কণ্ঠ শুনলেও মনে নেই, যে আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং যে কিনা বিবাহিত। এবং তাকে তখন ভালবেসেছি যখন সে আমার সীমার বাইরে।অন্যদের মতো in return ভালবাসা expect করার সুযোগও নেই। ভালবাসা হয়তো মানবতার মধ্যে। আমি যখন মফস্বলে ছিলাম, পাড়ায় এক হিন্দু পাগলি থাকতো। লোকের মুখে শুনেছি, বিয়ের অল্পদিন পরেই স্বামী মারা যায় মেয়েটির। কিন্তু মেয়েটি বিধবার বেশ নিতে কোনোমতেই রাজী হয় নি। সে দাবি করতো, বিয়ে আত্মার মিলন, মিলন হয়ে গেছে। তাইস্বামীর আত্মা দেহ ছাড়লেও ওর আত্মা থেকে আলাদা হতে পারে নি। দিব্যি শাঁখা-সিঁদুর পরে ঘুরে বেড়াত। বেশ কয়েকবার দেখেছি মেয়েটিকে। এতো লম্বা ও মোটা করে সিঁদুর কোন সধবাকেও দিতে দেখিনি। কে বলবে, ও সধবা নয়? আলপনা আর পড়তে পারল না। মাথা ধরেছে অসম্ভব। মৃদুল ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে বিছানায়। আলপনা ডেক্সটপ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। মৃদুলকে বলল, কটা পর্যন্ত জাগবে? এইতো আর কিছুক্ষণ। লাইটটা অফ করো কিন্তু। ওকে। আচ্ছা, শোনো বলো আমি মরে যাওয়ার পরও কি তুমি আমায় ভালবাসবে? মৃদুল ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আলপনার দিকে তাকালো। বলল, কেন? মারা যাচ্ছ নাকি? না, এমনি, জানতে ইচ্ছে হলো। দুনিয়াতে সবকিছুই আপেক্ষিক, পরিবর্তনশীল। অনুভূতিও বদলাতে পারে। বলেই হো হো করে হেসে দিলো মৃদুল। আবার ল্যাপটপে কাজ শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর আলপনাবলল, আচ্ছা, শোনো। বলো না থাক, কিছু না।
Posted on: Wed, 22 Oct 2014 08:18:39 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015