হিন্দুরা কি - TopicsExpress



          

হিন্দুরা কি বহু-ঈশ্বরবাদী ? আমার কিছু ভাবনা ------- -------------------------------------------- হিন্দু-ধর্মে বহু দেবতার উল্লেখ থাকলেও হিন্দুরা বহু-ঈশ্বরবাদী নন । বস্তুতঃ তথাকথিত একেশ্বরবাদীদের থেকেও বেশী গভীরে অগ্রসর হয়ে হিন্দুরা আবিষ্কার করেছেন জগতের এক অখণ্ড সত্তার তত্ত্ব , যা আধুনিক বিজ্ঞান-দ্বারাও স্বীকৃত । এই জগৎ এক অখণ্ড সত্তার প্রকাশ । জগতের আপাত বহুত্বের পিছনে রয়েছে এই একত্ব । এই এককেই হিন্দুরা ব্রহ্ম বলেন । এই জগৎ ব্রহ্মেরই আপাত-প্রতীয়মান রূপ । আর দেবতাগণ ? তাঁরা কি বহু নন ? না তাঁরাও এক । ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে : ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্যঃ সুপর্ণো গরূত্মান্। একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ ।। (-ঋগ্বেদ. ১।১৬৪।৪৬ ) যাঁঁকে সকলে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ অগ্নি প্রভৃতি বলে—সেই সত্তা একই; ঋষিরা তাঁকে বহু নামে ডাকে— ‘একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’-- সেই এক নিত্য সত্তাই বহুরূপে কথিত হন । প্রাথমিকভাবে এইসব দেবতারা পৃথক পৃথক ভাবে কল্পিত হয়েছেন । যেমন জলের দেবতা বরুণ , বজ্রের দেবতা ইন্দ্র ইত্যাদি । কিন্তু হিন্দু ঋষিদের আধ্যাত্মিক গবেষণার অগ্রগতির সাথে সাথে এইসব বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী দেবতারা তাঁদের স্বাতন্ত্র হারাতে লাগলেন এবং এক অনির্বচনীয় সত্তার সাথে একীভূত হতে লাগলেন । এই অনির্বচনীয় সত্তাই জগদীশ্বর । তিনিই এই জগতের পরিচালক । যেমন বেদে প্রাথমিক ভাবে বরুণদেবতার সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে , ইনিও ইন্দ্রের মতো অন্তরীক্ষের দেবতা ও বৃষ্টির অধিপতি। তারপর দেখতে পাই, তিনি উচ্চাসনে উন্নীত; তাঁকে সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান্ প্রভৃতি বলা হচ্ছে । বরুণদেবের সম্পর্কে একটি বৈদিক স্তোত্রে বলা হল : ... আমাদের কার্যচয় উচ্চ হ’তে দেখিবারে পান, যেন অতি নিকটেই প্রভুদেব সর্বশক্তিমান্। যদিও মানুষ রাখে কর্মচয় অতীব গোপন, স্বর্গ হ’তে দেবগণ হেরিছেন সব অনুক্ষণ। যে-কেহ দাঁড়ায়; নড়ে, গোপনেতে যায় স্থানান্তর, সুনিভৃত কক্ষে পশে, দেবতার দৃষ্টি তার’পর। উভয়ে মিলিয়া যেথা ষড়যন্ত্র করে ভাবি মনে, কেহ না হেরিছে দোঁহে, মিলিয়াছে অতি সঙ্গোপনে। তৃতীয় বরুণদেব সেই স্থানে করি অবস্থান, দূরভিসন্ধির কথা জ্ঞাত হন সর্বশক্তিমান্। এই যে রয়েছে বিশ্ব—অধিপতি তিনি গো ইহার, ওই যে হেরিছ নভঃ সুবিশাল সীমাহীন তাঁর। বাজিছে তাঁহারই মাঝে অন্তহীন দুটি পারাবার, তবু ক্ষুদ্র জলাশয় রচেছেন আগার তাঁহার। বাঞ্ছা যার আছে মনে উঠিবারে উচ্চ গগনেতে, বরূণের হস্তে তার অব্যাহতি নাই কোনমতে। নভঃ হ’তে অবতরি চরগণ তাঁর নিরস্তর, করিছে ভ্রমণ অতিদ্রুত সারা পৃথিবীর ’পর। দূর দূরতম স্থানে লক্ষ্য তারা করিছে সতত, পরীক্ষাকুশল নেত্র বিস্ফারিত করি শত শত। ( অথর্ববেদ, কাণ্ড ৪, সূঃ ১৬; এখানে বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত হল । ) স্পষ্টতঃ এখানে বরুণদেব তাঁর সীমাবদ্ধ অধিকারের পরিবর্তে জগদীশ্বরের আসনে উপনীত । অন্যান্য দেবতা সম্বন্ধেও এইরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হতে পারে। তাঁরা একের পর এক সেই একই অবস্থা লাভ করেন। প্রথমে তাঁরা অন্যতম দেবতারূপে আরাধিত হন, কিন্তু তারপর সেই পরমসত্তারূপে গৃহীত হন, যাঁতে সমগ্র জগৎ অবস্থিত, যিনি প্রত্যেকের অন্তর্যামী ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা । এভাবেই হিন্দুধর্মে একেশ্বরের ধারণা বিস্তারলাভ করে । অন্যান্য ধর্মগুলো এখানেই এই একেশ্বরবাদেরই তাদের অগ্রগতির ইতি ঘটিয়েছে কিন্তু ভারতের প্রাচীন ঋষিরা অন্তর্জগতের আরও গভীরে অনুসন্ধান চালালেন । এবং এই সর্বশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন , অয়মাত্মা ব্রহ্ম । আমিই ব্রহ্ম । যে জগদীশ্বরকে আমরা বাইরে অনুসন্ধান করছিলাম তিনি আমাদের ভিতরে । তিনি আমাদের স্বরূপ । এই জগতই স্বরূপতঃ ব্রহ্ম । গীতা শিক্ষা দিচ্ছে , সমং সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্তং পরমেশ্বরম্ । বিনশ্বৎস্ববিনশ্যন্তং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।। সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্ । ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্ ।। ( গীতা - ১৩ /২৮-২৯ ) অর্থাৎ, অবিনাশী ঈশ্বরকে যে সাধক বিনাশশীল সর্বভূতে ( জীব জগৎ সর্বত্র ) সমভাবে দেখেন তিনিই যথার্থ দর্শন করেন ; সর্বত্র সমভাবে সেই ঈশ্বর অবস্থিত দেখে সেই সমদর্শী আর কাউকে হিংসা করতে পারেননা । সেইজন্য তিনি পরম গতি প্রাপ্ত হন । আমাদের ধর্মের সর্বোচ্চ শাস্ত্রগ্রন্থ উপনিষদেও এই জাগতিক সবকিছুর মূল স্বরূপ হিসাবে সেই অনন্ত চৈতন্যময় ঈশ্বরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে । ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী । ত্বং জীর্ণো দন্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি - বিশ্বতোমুখঃ ।। ( শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৩) অর্থাৎ তুমি স্ত্রী , তুমি পুরুষ , তুমি কুমার , তুমি কুমারী , তুমি বৃদ্ধ - দণ্ডহস্তে ভ্রমণ করছ , তুমি জাত হয়ে নানা রূপ ধারণ করেছ । অনেকে ভাবেন তাহলে হিন্দুরা বুঝি ইট , কাঠ , মাটি , মানুষ জীবজন্তু এই সবের উপাসনা করে । কিন্তু আগেই বলেছি , হিন্দু ধর্মের সিদ্ধান্ত হল , জগৎ স্বরূপতঃ ঈশ্বর । এই স্বরূপতঃ কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । ধরুন অন্ধকারে একগাছা দড়ি পড়ে আছে । আপনি ওটাকে সাপ ভেবে ভয় পেলেন । পরে আলো এনে দেখলেন , ওটি সাপ নয় - দড়ি । তখন আপনার সর্পভীতিও চলে গেল । ঠিক তেমনি আমরা ভ্রমাত্মক দৃষ্টিতে জগৎকে জগৎরূপে দেখছি । মায়ামুক্ত হলে এই জগৎকেই ব্রহ্মরূপে অনুভব হবে । আপনি যখন দড়িকে সাপ দেখছিলেন , তখন কিন্তু আপনার দড়ি-জ্ঞান ছিলনা । আবার যখন দড়ি-জ্ঞান এল , তখন সর্পজ্ঞান চলে গেল । ঠিক তেমনি আপনি যখন সাপকে সাপ হিসাবে কিম্বা বানরকে বানর হিসাবে ভাবছেন তখন ওরা আপনার কাছে ঈশ্বর নয় । কিন্তু যখন আপনার ওদের স্বরূপের উপলব্ধি হবে , তখন ওরা আপনার কাছে ঈশ্বররূপে প্রতিভাত হবে । মনে করুন আপনি একটি মাটির হাতি বানিয়েছেন আর আমি মাটির ঘোড়া বানিয়েছি । এখন মাটির হাতি আর মাটির ঘোড়া এক নয় । নাম ( একটির নাম হাতি , অপরটির নাম ঘোড়া ) ও রূপ ( একটির ঘোড়ার আকৃতি ও অপরটির হাতির আকৃতি ) এদের মধ্যে পার্থক্য সুচিত করেছে । কিন্তু স্বরূপের দিক থেকে ওরা এক কারণ এদের উভয়েরই স্বরূপ হল মাটি । এই নাম-রূপ দুটিই মিথ্যা । কারণ পরে এদের কোনও অস্তিত্ব থাকেনা । স্বরূপটিই চিরন্তন । জীব জগত সহ গোটা ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ হলেন ঈশ্বর । বেদে ঈশ্বরকে জগতের নিমিত্ত কারণ ও উপাদান কারণ বলা হয় । নিমিত্ত কারণ মানে হল ঈশ্বর নিজে এই জগত সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তিনিই এই জগতের নিমিত্ত । আর উপাদান কারণ মানে হল ঈশ্বর এই জগতের উপাদান । যেমন মাটি ছিল খেলনা হাতি বা ঘোড়ার উপাদান । ধরুন কুমোর একটি মাটির পাত্র বানালো । এখানে পাত্রটির নিমিত্ত কারণ হল কুমোর এবং উপাদান কারণ হল মাটি । ঈশ্বর এই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান দুইই । একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানেই জগতের এই অভেদতত্ত্ব বা স্বরূপতঃ ঈশ্বরত্ব প্রতিভাত হয় । যিনি জগতকে বহুরূপাত্মক দেখছেন , তাঁর দৃষ্ট জগৎ ঈশ্বর নয় । বিভিন্নতার অন্তরালে জগতের স্বরূপ হল একত্ব । এই একত্বই ঈশ্বর । হিন্দুধর্ম তত্ত্ব অনুযায়ী এই বহুত্ব পূর্ণ জগতের পিছনে একত্ব রয়েছে । এবং জগতের ভিত্তি স্বরূপ সেই একত্ব হল অখণ্ড চৈতন্য বা ঈশ্বর । আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান quantum potential ভিত্তিক holistic approach দ্বারা জগতের এই একত্বের দিকে , এই স্বরূপতঃ অখণ্ডতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে । বিজ্ঞানী ডেভিড বোহম্ , বিজ্ঞানী বেসিল হিলি প্রমুখ বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীর গবেষণা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । বিজ্ঞানী বোহম্ পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন Bells Theorem কে , যা জগতের এক ও অখণ্ড সত্তার কথা বলে । এই তত্ত্ব অনুসারে বিশ্বের সবকিছু যুক্ত আছে unbroken wholeness এর সঙ্গে । _______________________
Posted on: Wed, 22 Oct 2014 14:02:27 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015