৭ই মার্চের ভাষণ.......জয় - TopicsExpress



          

৭ই মার্চের ভাষণ.......জয় পাকিস্তান বিতর্ক ........ - নির্মল সেন ১ মার্চ ১৯৭১ সাল। প্রেস ক্লাবে বসেছিলাম। হঠাৎ শুনলাম একটি কণ্ঠ। সেই কণ্ঠের অধিকারী প্রেস ক্লাবে ঢুকেই বলল, ‘সর্বনাশ হো গিয়া।’ আমি তার দিকে তাকালাম। সে লোকটি আর কেউ না, পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আসরার আহমদ। তখন সারা পাকিস্তানে এই ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নই একমাত্র অবিভক্ত ছিল। আমি আসরারের দিকে তাকালাম, বললাম ‘কেয়া হুয়া?’ আসরার সবেমাত্র পিআইএ বিমানে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় পৌঁছেছে। সে বলল, পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে। এর ফল যে ভালো হবে না তা সবাই জানে। ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। তারই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নানা টালবাহানা করে শেখ সাহেবকে মন্ত্রিসভা করতে ডাকছেন না। কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অন্য একটি ধারণা এবং পরিকল্পনা ছিল। সেনাবাহিনী ভেবেছিল, শেখ সাহেব নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। বাকি দলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। তাই তাদের কাছে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু জনতার রায় ছিল ভিন্ন। তারা শেখ সাহেবকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিল। কিন্তু সামরিক বাহিনী শেখ সাহেবকে ক্ষমতা দিতে রাজি নয়। তাই নানা টালবাহানা শুরু করেছিল। সর্বশেষ ইয়াহিয়া বলেছিল, ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে। কিন্তু সেই অধিবেশন না বসার খবর নিয়েই বিভ্রান্ত হয়ে আসরার ঢাকায় এসেছিল। ইয়াহিয়ার ঘোষণায় যে প্রতিক্রিয়া হলো তা আমরা অচিরেই টের পেলাম। সেদিন দুপুরে হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলন ছিল। সে সম্মেলন ছাত্র এবং জনতা, অফিস কর্মচারীসহ সবাই ঘেরাও করল। তাদের দাবি এখনি বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে। সমস্ত বাংলাদেশে আকাশ-বাতাস মথিত হলো একটি শ্লোগানে। সেই শ্লোগানটি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই; স্বাধীন বাংলা চাই। অবাঙালিদের সঙ্গে আমরা থাকব না। সেদিন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জনতাকে শেখ সাহেব নিবৃত্ত করলেন। বলা হলো, রেসকোর্সে ৭ মার্চ শেখ সাহেব ভাষণ দেবেন। আমরা সেই ৭ মার্চের ভাষণের জন্য গভীর প্রতীক্ষায় ছিলাম। এর মধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেছে। স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছে। শেষ পর্যন্ত ৭ মার্চ এলো। তারপর ৭ মার্চ রেসকোর্স লোকে লোকারণ্য। দক্ষিণ রমনা কালীবাড়ি, উত্তরে ঢাকা ক্লাব, মানুষ যেন উপচে পড়ছে। চারদিক মানুষ যেন আসছে আর আসছে। সবার হাতে লাঠি। এ যেন রেসকোর্সে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করবে। সবার কণ্ঠে স্বাধীনতা চাই। আজকে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা চাই, মঞ্চে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। তাদের কণ্ঠে আমাদের নেতা পাকিস্তানের পার্লামেন্টে যাবেন না। শেখ মুজিব পাঞ্জাবিদের পার্লামেন্টে যাবেন না। পাঞ্জাবিদের পার্লামেন্ট মানি না, মানি না, সবাই হাতে অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। এর মধ্যে শেখ সাহেব জনসভায় এসে পৌঁছলেন। তখন লাখ জনতার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি, তারা বারবার বলছে, পাঞ্জাবিদের পার্লামেন্টে আমাদের নেতা যাবেন না। এরপর বজ্রনির্ঘোষের মতো গগনবিদারী কণ্ঠে তার ভাষণ শুরু করলেন। এমন সুলিখিত ভাষণ কোনোদিন শুনিনি। কি ভাষণ? আর শেখ সাহেবের কি গগনবিদারী কণ্ঠ? গোটা জনসভায় এক উন্মাদনা সৃষ্টি করল। শেখ সাহেবের ভাষণের মাঝে মাঝে পেছনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। পেছনে ছিল ছাত্রলীগ নেতারা। তিনি এবারের সংগ্রাম, মুক্তি সংগ্রাম বলে একটু থামলেন এবং পেছনে ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানের কাছে কি যেন জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর তিনি বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ..........জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান। শেখ সাহেবের মঞ্চে সামনের সারিতে চেয়ারে আমি ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বসে ছিলাম, যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। শেখ সাহেবের ভাষণের প্রতিটি অক্ষর গোগ্রাসে গিলছিলাম। এরপর সভা ভাঙল। জনতার একটি অংশের মনে যেন কিছু না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে গেল। তারা সবাই ওইদিনই চেয়েছিল শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করুক। কিন্তু তা শেখ সাহেবের পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিল না। তিনি অনুভব করেছিলেন, সংগ্রামের সময় উপস্থিত না-ও থাকতে পারেন। এই দুরদৃষ্টির ফলে তিনি বলেছিলেন আমি যদি নির্দেশ দিতে না পারি তাহলে তোমাদের কাছে নির্দেশ রইল যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে। এরচেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আর কি নির্দেশ থাকতে পারে? আমি জানি, আমার এ বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক আছে, কানাডা থেকে একদল ছেলে লিখে জানিয়েছেন, আপনি মিথ্যা লিখেছেন। কানাডা কেন? ঢাকারও অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস আমি মিথ্যা বলেছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার স্মৃতি আমাকে বিভ্রান্ত করেনি। এবং আমার মতে, সেদিন জয় পাকিস্তান বলে শেখ সাহেব সঠিক কাজ করেছিলেন। একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে আমি একটি ভিন্ন কথা শুনেছি। বিশেষ করে বামপন্থী মহল এটা বলেছে। তারা সমালোচনা করেছে, শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন না কেন? আবার একই মুখে বলেছেন শেখ সাহেব বুর্জোয়া নেতা। তিনি কিছুতেই স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে পারেন না। আমার মত হচ্ছে, জয় পাকিস্তান না বলে কোনো উপায় ছিল না। তখনো আলোচনা শেষ হয়নি। ক’দিন পর ইয়াহিয়াদের সঙ্গে আলোচনা করার কথা। একটি লোকও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত নয়। সেদিন যদি জয় পাকিস্তান না বলে শুধু ‘জয় বাংলা’ বলতেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তাহলে ইয়াহিয়া বাহিনী মারমুখী আক্রমণ করত। লাখ লাখ লোক প্রাণ হারাতো। তখন এই মহলটিই বলত জনতাকে কোনো প্রস্তুত না করে এ ধরনের স্বাধীনতা ঘোষণা বালখিল্যতা। এ জন্যই অসংখ্য লোকের প্রাণহানি হয়েছে এবং এর জন্যই শেখ মুজিবের বিচার হওয়া উচিত। এছাড়া জয় পাকিস্তান বলা সম্পর্কে আমার সঙ্গে শেখ সাহেবের আলাপ হয়েছিল। আমি বললাম, আপনি জয় পাকিস্তান বললেন কেন? শেখ সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। এরপর তিনি বললেন, ‘আমরা খাবার টেবিলে ছেলেমেয়ে সবাই খেতে বসতাম। প্রথমে আমরা এক হাতের পাঁচটি আঙ্গুল অপর হাতের একটি আঙ্গুল অর্থাৎ ছয়টি আঙ্গুল দেখাতাম। অর্থাৎ এই ছয়টি আঙ্গুল ছিল ছয় দফা। পরে পাঁচটি আঙ্গুল নামিয়ে ফেলতাম। বাকি থাকত একটি আঙ্গুল। অর্থাৎ এক দফা। অর্থ হচ্ছে ছয় দফার শেষ কথা হচ্ছে এক দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেদিন পাঁচ আঙ্গুল নামিয়ে ফেলার পর আমার কনিষ্ঠপুত্র রাসেল জিজ্ঞাসা করেছিল। তুমি আজকের জনসভায় জয় পাকিস্তান বলতে গেলে কেন? “আমি কি রাসেলের প্রশ্নের জবাব আপনাকে দেব? আমাকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হলে অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারকে শেষ কথা বলতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে ভুট্টো। তার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। আমি এই আলোচনা শেষ না করে কিছু করলে পৃথিবীতে আমি জবাবদিহি করতে পারব না। আমি এখন ভালো অবস্থানে আছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। এই প্রেক্ষিতে আমি কিছুটা aggressive হতে পারি মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। আমাকে আমাদের সেনাবাহিনী ও সরকারের কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। সেই আলাপ এখনো শেষ হয়নি। সবদিকে এত অপ্রস্তুত রেখে একটি দেশকে আমি সংগ্রামের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। আপনি কি বোঝেন না ওইদিন চারদিকে শত্রু বেষ্টিত অবস্থায় আমার অন্য কিছু বলার ছিল না।” এই হচ্ছে ৭ মার্চ শেখ সাহেবের বক্তব্য সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা। আমার এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে এখনো অনেক মন্তব্য শুনি। কিন্তু তাদের কি স্মরণ নেই, ২৫ মার্চ কি অগোছালো অবস্থায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল? এটা যদি ৭ মার্চ হতো তাহলে আরো লাখ লাখ প্রাণ আমাদের হারাতে হতো। একথা কি সত্য নয়? যারা সেদিন শেখ সাহেবের সমালোচনা করেছিলেন, তারা বুকে হাত দিয়ে বলুন, শেখ সাহেব কি ভুল করেছিলেন? ওই ভুলটুকু না করলে আপনারা কোথায় পালিয়ে যাবেন সে সন্ধানও করার সময় পেতেন না। শেখ সাহেব যে জয় পাকিস্তান বলেছিলেন তার অন্যতম সাক্ষী আমার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক লন্ডন প্রবাসী আবদুল গাফফার চৌধুরী। আমি জানি না, সে কথা আজ তার মনে আছে কিনা। তবে তিনি আমার সঙ্গে জনসভায় প্রথম সারিতে বসে ছিলেন। লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতিক...নির্মল সেন
Posted on: Mon, 08 Sep 2014 06:43:17 +0000

Trending Topics



class="stbody" style="min-height:30px;">
To the sound of a heartbeat pounding away To the rhythm of the
OCTOBER 9, 1964: MILESTONE: Beach Boys and a Guest The Beach
Still trying to pressure the Texas Board of Veterinary Medical
Daily Devotional: For so an entrance shall be ministered unto you

Recently Viewed Topics




© 2015