ছোট বেলায় মফস্বল কিংবা - TopicsExpress



          

ছোট বেলায় মফস্বল কিংবা গ্রাম এলাকাতে আমরা ছোট ছোট বাচ্চারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতাম। এখনকার শহুরে বাচ্চারাও ওঠে, তবে তারা মর্নিং শিফটের স্কুল করার জন্য ওঠে। রাত ২-৩ টা পর্যন্ত সজাগ থেকে সকাল ৭ টার সময়ে খুব একটা মজা করার মুড নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে না। আম্মুর বকুনিতে বিরক্ত হয়ে উঠে যায়। তবে আমাদের অবস্থা ছিলো পুরাই উল্টো। আমরা বরং ঘুমের ওপর বিরক্ত হয়েই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে যেতাম। রাত ১০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে গেলে, সকাল ৬ টা বাজার অনেক আগেই ঘুমের ওপর বিরক্তি চলে আসা স্বাভাবিক। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই অর্থাৎ সকাল ৫ টার দিকেই আমরা কয়েকজন বন্ধু একটা করে বই নিয়ে স্কুলের পথে রওয়ানা হতাম। স্কুলের ক্লাশরুমগুলোর দরজা সেই কাকডাকা ভোরে বন্ধ থাকত। আমরা কয়েকটা জানালা বেশ কিছুটা বাকা করে সেখান থেকে নিজেদের প্রবেশ করার মত জায়গা করে নিয়েছিলাম। সাঝ-সকালে আমাদের এই স্কুলে উপস্থিত হওয়ার কথা শুনে অনেকেই ভাববে আমরা মনে হয় লেখাপড়ায় খুব আগ্রহী ছিলাম। আসলে ওসব কিছুই না, ভোর বেলায় আমরা সাথে নিয়ে আসা বইটি সামনের বেঞ্চে রেখে যেতাম এবং সাড়ে ৯ টার দিকে যখন ক্লাস শুরু হত তখন সেই বই রাখার কারনে দখলকৃত জায়গায় আমরা বসে পরতাম। স্কুলে বই রেখে আমরা চলে যেতাম এর-ওর ফলের বাগানের উৎপাদন কেমন হচ্ছে সেটা যাচাই করতে। প্রতিদিনই আমরা বিভিন্নজনের বাড়িতে লাগানো দুনিয়ার সবচেয়ে বিদঘুটে ফলগুলোর সন্ধানে বের হতাম। বিভিন্ন গাছের ফল খেয়ে আমরা তাদের মাঝে গুনগত পার্থক্য নির্নয় করতাম। তবে কৃষি অফিসারের মত ফলের মান যাচাইয়ে আমাদের করা অডিট কার্যক্রম কোনো গাছের মালিকই ভালোভাবে নিত না এবং সেই মূর্খরা আমাদের চোর বলেই ডাকতো। আমাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা ফলগুলোর মফস্বল বা গ্রাম এলাকায় কোনো বাজারমূল্য থাকত না। তারপরও ওগুলো খাওয়ার কারনে আমাদের কেনো চোর ডাকা হত সেটা বুঝতাম না। পছন্দের ফলের মাঝে ছিলো ঢেউয়া, করমজা, সরবতি, জাম্বুরা, জাম, বেতফল, হরবড়ই, কাউফল, আশফল ইত্যাদি। আম, কাঠালের মত উঁচু মানের ফলগুলো আমাদের কাছে কখনোই খুব একটা মর্যাদা লাভ করেনি। কারন ওগুলো দুস্প্রাপ্য ছিলনা। এই পুরো অভিজান শেষ করে আমরা যখন বাসায় ফিরতাম তখন ঘড়ির কাটায় হয়তোবা সোয়া সাতটা বেজেছে। শহরের বাচ্চাগুলো যখন পড়ছে B for Blueberry, Blueberry মানে জাম, তখন আমরা চুরি করে আনা জাম বাটিতে নিয়ে, লবন মাখিয়ে, খেয়ে দেয়ে জিহ্বা Navyblue করে ফেলেছি। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলতো আমাদের পড়াশুনা। সে পড়াশুনা কে কত মনযোগ দিয়ে করছে তার মাপকাঠি ছিলো গলার স্বরের উচ্চতা। এখনকার শহুরে বাচ্চাদের জন্য নাকি আলাদা রুম লাগে, একজন জোরে পড়লে আরেকজনের পড়তে সমস্যা হয়। কিন্তু আমারা আজকের বাচ্চাদের মত এতটা অনুভূতিপ্রবন ছিলাম না। গরমের দিনে আমরা ঘরের বাইরে কোনো একটা গাছের ছায়াতে শীতলপাটি বিছিয়ে ৪-৫ জন বসে পড়তাম। আমাদের সমন্বিত পড়ার শব্দ প্রায় অর্ধ কিলো দূরে বসেও পুথি পড়ার মত শোনা যেত। পড়াশুনা নামের চিৎকার-চেচামেচি শেষ করে আমরা ৯ টার দিকে কতগুলো পান্তা কিংবা গরম-পান্তা খেয়ে স্কুলে রওয়ানা দিতাম। গরম-পান্তা মানে হলো গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গরম ভাতেই পানি ঢেলে তৈরী করা পান্তা। স্কুলে পৌছে আমরা যখন পূর্ন উদ্যমে রাতে ও সকালে পড়া(!) বিদ্যাগুলো উগড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিতাম ঠিক সেই সময়ে শহরের ক্লান্ত-শ্রান্ত প্রায় নিদ্রাহীনভাবে কাটানো বাচ্চাগুলো ব্রয়লারের মুরগির মত ঝিমানো শুরু করে। এই ঝিমুনি চলে সেই রাত ২ টা পর্যন্ত। সারাদিন ক্লাস-কোচিং-প্রাইভেট টিউটর, সবখানেই ঝিমুনির জয়গান চলে। অন্যদিকে আমরা স্কুলের টিফিন পিরিয়ডেও বাড়ি থেকে খেয়ে এসে আবার অন্য কিছু চুরির ধান্দায় থাকতাম কিংবা খেলাধুলা করতাম। বিকেলে দু-তিন ঘন্টা খেলা তো থাকতোই। গ্রামের বাচ্চাগুলোর শৈশব রঙ্গীন, তাদের শৈশবগুলো আঁকা হয় প্রকৃতির তুলি দিয়ে। শহরের বাচ্চাগুলোর শৈশব হয়তোবা আরো অনেক বেশি রঙ্গীন, কিন্তু তাদের শৈশবগুলো আঁকা হয় কম্পিউটার, গেইম, প্লেষ্টেশন টাইপের কৃত্তিমতার তুলি দিয়ে। গ্রামের অফুরন্ত জীবনীশক্তিসম্পন্ন বাচ্চাগুলোকে আরো মেধাবী করতে ওদের জন্য শিক্ষাকে আরেকটু সহজলভ্য করে দেয়া উচিৎ, আর শহরের তথাকথিত মেধাবী বাচ্চাগুলোর মেধা কাজে লাগানোর জন্য ওদেরকে আরেকটু শক্তিশালী করা উচিৎ। সেজন্য ওদের ওপর থেকে শিক্ষার চাপ একটু কমানো দরকার।
Posted on: Wed, 19 Jun 2013 03:57:53 +0000

Trending Topics



Recently Viewed Topics




© 2015